বিদেশ ডেস্ক:

আবার পুড়ছে মিয়ানমারের রাখাইন। পুড়ছে পৃথিবীর সবথেকে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর সহায়-সম্বল-ভাগ্য। ব্রিসবেন টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,  ডি-ফ্যাক্টো সরকারের সেনারা ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যজুড়ে। প্রতিবেদনে সেনা উপস্থিতির যে চিত্র ধরা দিয়েছে, তাতে একে ‘জলপাই রঙের অন্ধকার’র সামিল বলে মনে হচ্ছে। বাড়ির পর বাড়িতে আগুন জ্বলছে। চলছে রাউন্ডে রাউন্ডে গোলাগুলি। নিহতদের শোকে বাকরুদ্ধ আত্মীয়স্বজন। চারদিকে কান্নার শব্দ। স্বজনের লাশ পেছনে ফেলে রুদ্ধশ্বাসে পালাচ্ছে মানুষ। তবে পালিয়েই রেহায় মিলছে না তাদের। কাতারভিত্তিক আলজাজিরা খবর দিয়েছে, পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলেই গুলি করা হচ্ছে বেসামরিক রোহিঙ্গাদের। যারা গোলাগুলির শিকার হচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। 

মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো সরকার এক বিবৃতিতে বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট)  রাখাইন রাজ্যের ‘বিদ্রোহী রোহিঙ্গা’রা ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে সমন্বিত হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করে। দাবি অনুযায়ী রাতভর  সংঘর্ষে রোহিঙ্গা-পুলিশ-সেনাসনদস্য মিলে অন্তত ৯২ জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত করে সেনাসূত্র।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমকে উদ্ধৃত করে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা চলতি মাসের ১২ তারিখ জানিয়েছিল, মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের সুনির্দিষ্ট অঞ্চলে নতুন করে কারফিউ জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখানকার সেনা-গণতান্ত্রিক ডিফ্যাক্টো সরকার। একই সময়ে  মোতায়েনকৃত সেনার সংখ্যা বাড়ানোর খবর দিয়েছিল ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স। ১৭ আগস্ট সাউথ এশিয়া মনিটর-এর প্রতিবেদনে  সেনা অভিযান শুরুর কথা জানানো হয়।  ঘটনার কয়েকদিনের মাথায় বৃহস্পতিবার পুলিশ চেকপোস্টে হামলা এবং রোহিঙ্গা বিদ্রোহী-পুলিশ সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়।

ব্রিসবেন টাইমস-এর খবরে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ওই সহিংসতার পর জাই ডি পাইন নামের একটি গ্রামে সমবেত হয়েছেন আতঙ্কিত প্রায় ৭০০ রোহিঙ্গা। তাদের একজন বলেছেন, চারদিকে বাড়িতে আগুন। জীবন বাঁচাতে আমরা পালাচ্ছি। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করেন মোহাম্মদ শফি। তিনি বলেছেন, তার এক চাচাত ভাই অবস্থান করছেন মিয়ানমারে। তিনি ব্রিসবেন টাইমসকে টেলিফোনে বলেছেন, যেদিকে চোখ রাখা যায় সেদিকেই সেনাবাহিনীর উপস্থিতি।

আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা এড়াতে পালানোর চেষ্টা করা বেসামরিক রোহিঙ্গাদের উপর গুলি ছুড়ছে সেনারা। বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা করা এসব রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। শনিবার বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদক বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্তে ১২টিরও বেশি মর্টার শেল ও মেশিনগানের অসংখ্য গোলাগুলির খবর নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, সীমান্তবর্তী একটি পাহাড়ি এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের উপর এই গুলি ছুড়েছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। তবে এতে এখনও কোনও হতাহতের খবর জানা যায়নি।

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের আলাদা কোনও জাতিগোষ্ঠীই মনে করে না। বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত ওই জনগোষ্ঠীকে তারা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করে দায়িত্ব অস্বীকার করতে চায়। তবে রোহিঙ্গারা নিজেদের মিয়ানমারের নাগরিক বলেই জানে। নাগরিকত্বকে তারা অধিকার হিসেবেই দেখে। তবে নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে গিয়েও তারা অজ্ঞাত হামলার শিকার হচ্ছেন বলে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক পর্যবেক্ষণে উঠে আসে।  বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষের পর দেওয়া বিবৃতিতে  রোহিঙ্গাদের বাঙালি উল্লেখ করা হয়। আর ব্রিসবেন টাইমস-এর শনিবারের এক প্রতিবেদন বলছে, বিদ্রোহী রোহিঙ্গা ও নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের মধ্যে লড়াই তীব্র হওয়ার প্রেক্ষিতে আবার নতুন করে শরণার্থীদের ঢল নামছে বাংলাদেশের দিকে।

বিজিবির স্টেশন প্রধান মানজুরুল হাসান খান বলেন, ‘তারা বেসামরিকদের উপর গুলি ছুড়েছে যাতের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এখন তারা জিরো লাইনের নিকটবর্তী পাহাড়গুলোতে লুকিয়ে আছে। তারা বিজিবির সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই হঠাৎ করে মর্টার ও গুলি শুরু হয়েছে।’ ইউরোপীয় রোহিঙ্গা কাউন্সিলের আনিতা সাগ আল-জাজিরাকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সুইজারল্যান্ডর সোলোদার্ন থেকে তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি সত্যি এবং আমাদের কাছে এর ভিডিও রয়েছে। নিশ্চিত করার প্রয়োজনে আমরা একটা প্রকাশ করতে পারি।তিনি বলেন, ছুরি, তরবারি ও রামদা নিয়ে রাখাইন উগ্রপন্থীরা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে নিষ্পাপ ও নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের উপর হামলা করছে।

গত বছরের অক্টোবরে একই ধরনের হামলায় ৯ পুলিশ নিহত হওয়ার পর রাখাইন রাজ্যে বড় আকারের সামরিক অভিযান হয়েছিল। তখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করার অভিযোগ ওঠে। জাতিসংঘ মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের সামিল বলে উল্লেখ করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা স্যাটেলাইট ইমেজ প্রকাশের মধ্য দিয়ে রাখাইনের দমনপীড়ন ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার তথ্য হাজির করে। তবে মিয়ানমার ওইসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে শুরু থেকেই। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কফি আনানের নেত্বত্বে আলাদা তদন্ত কমিশন গঠন করে তারা। সেই তদন্ত কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের একদিনের মাথায় নতুন করে হামলা ও সংঘর্ষ শুরু হয় বৃহস্পতিবার থেকে। শুক্রবার থেকে বেসামরিক রোহিঙ্গাদোএর ওপর সেনানিপীড়নের খবর সামনে আসতে শুরু করে।

মিয়ানমারএর ডি-ফ্যাক্টো সরকারের আমন্ত্রণেই রাখাইন পরিস্থিতি তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছিল কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশন। সেই তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদনেও সংখ্যার বিচারে রোহিঙ্গাদেরকে‘বিশ্বের সবথেকে বড় রাষ্ট্রহীন সম্প্রদায়’ হিসেবে অভিহিত করে নাগরিকতা নিশ্চিতের আহ্বান জানানো হয়। প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয় আরোপিত সমস্ত বিধিনিষেধ। এতে সতর্ক করা হয়, স্থানীয় জনগনের বৈধ অভিযোগ উপেক্ষিত হলে তারা জঙ্গিবাদে ঝুঁকতে পারে। নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর বৃহস্পতিবার চেকপোস্টে হামলার ঘটনা এবং শুক্রবার থেকে রাজ্যে সেনাদমনের বাড়বাড়ন্ত যেন কফি আনান কমিশনের আশঙ্কার প্রতিধ্বনি।