আব্দুল আলীম নোবেল

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের কৃষি খাতে দৃশ্যমান অভিঘাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০১০ অনুসারে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা, জলাবদ্ধতা, অতি উচ্চ ও নিম্ন তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও ঘন ঘন প্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলোচ্ছ্বাসের মতো ঘটনা ঘটছে। সারা দেশের তুলনায় উপকুলীয় জেলা কক্সবাজার, বরা বরেই বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে এই এলাকার কৃষক সমাজ চরম উপক্ষিত। অধিক লবণাক্ততা সহনশীল জাত ধানের ব্যবহার ও প্রয়োগ কক্সবাজারসহ উপকুলীয় এলাকায় আরো অনেক বেশি দরকার। এইটির কার্যক্রম কিছুটা দেখা গেলেও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অপর দিকে নারকে গাছ কূষির একটি অংশ। একই সাথে এটি আবার অর্থকড়ি ফসলও। দীর্ঘতম সুদ্রসৈকত কক্সবাজারে উপকুলীয় অঞ্চলে নারকেল গাছ লাগালে অন্তত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাথমিক ধাক্কা মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে এমনটি তথ্য অনেক গবেষণা রির্পোটে ওঠে এসেছে। একই সাথে বিশাল অর্থের যোগান দেবে এই গাছ। শুধু কক্সবাজারে নয় দেশের উপকূলীয় জেলা গুলোতে লাগানো যেতে পারে নারকে গাছ। এতে ক্সবাজারসহ সারা দেশের উপকুলীয় জেলায় নারকেল গাছ ও লবণাক্ততা সহনশীল জাতের ধান নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।

ধানের রোগবালাই ও পোকামাকড় বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন নতুন বায়োটাইপের উদ্ভবের ফলে ধান ফসলে এর আক্রমণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। মোরা, সিডর, আইলা, রেশমি, নার্গিস এসবের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯টি জেলার কৃষক ও কৃষি পরিবার। আইপিসিসির মতে, বর্তমান গড় তাপমাত্রার থেকে প্রতি ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে ধানের ফলন ৭-১০% কমে যাওয়ার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সমুদ্রের পানির উচ্চতা প্রায় এক মিটার বেড়ে যাওয়ার আশংকা করেছে। যার ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৭ শতাংশ জমি লবণাক্ত পানির মধ্যে তলিয়ে যাবে এবং প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রায় দুই কোটি মানুষ। অতি বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা ও বন্যায় প্রায় ২.০ মিলিয়ন হেক্টর জমির ধান কোনো না কোনোভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বৃষ্টিপাতের ধারার অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে সময়মতো বীজতলায় চারা উৎপাদন করা যায় না, ফলে ধানের রোপণ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দেরি হয়ে যায়, তদুপরি বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির অসম বণ্টনের কারণে দেশের প্রায় তিন মিলিয়ন হেক্টর জমির আমন ধান বিভিন্ন মাত্রার খরার কবলে পড়ে, ফলে ধানের ফলন তথা উৎপাদন কমে যায়।

বাংলাদেশ ভাটি অঞ্চলের দেশ হওয়ার কারণে অতি বৃষ্টি হলে বাংলাদেশের প্রায় ২.৫ মিলিয়ন হেক্টর জমির আমন ধান এক বা একাধিক দফায় স্বল্প অথবা দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে ১৯টি জেলায় প্রায় ১.২ মিলিয়ন হে. জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততা কবলিত। এসব জমিতে স্থানীয় জাতের আমন ধান চাষ করার পর জমি পতিত থাকে। বর্ষা মৌসুমে উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাসে আমন ফসলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সৃষ্টি হয় লবণপানির জলাবদ্ধতা। শুষ্ক মৌসুমে উপকূলীয় এলাকায় মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর জমি আমন চাষের পর পতিত থাকে।

ক্রমহ্রাসমান প্রাকৃতিক সম্পদ, আবাদি জমি ও পানি অন্যদিকে বাড়তি জনসংখ্যা তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) জলবায়ু অভিঘাত সহনশীল আউশ-আমন-বোরো ধানের জাত, ধানভিত্তিক লাভজনক শস্যক্রম/মাছ চাষ ও নিবিড়তা বৃদ্ধি (শস্য বহুমুখীকরণ), কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই ও পোকামাকড়ের সমন্বিত দমন, টেকসই মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, খামার যান্ত্রিকীকরণ, ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাতের অভিযোজন ম্যাপ, বিভিন্ন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্ট্রেস এরিয়া ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে, ঔষধি ও জিংকসমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবন, ভালো কৃষি অনুশীলন, দেশের কৃষি অঞ্চলভিত্তিক লাগসই ধানের জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। তদুপরি, ব্রি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ব্রি ৪টি হাইব্রিডসহ ৮০টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এ ছাড়াও ১২২টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন, প্রতি বছর প্রায় ১০০ টন ব্রিডার বীজ বিতরণের মাধ্যমে কৃষকপর্যায়ে উন্নতমানের বীজ সরবরাহ করা। ব্রি প্রযুক্তি সম্প্রসারণে প্রশিক্ষণ প্রদান, রাইস নলেজ ব্যাংক, মাঠ প্রদর্শনীর পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিএডিসি, প্রাইভেট কোম্পানি, এনজিও, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থার সহযেগিতায় ব্রি প্রযুক্তিসমূহ মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

লবণ সহিষ্ণু জাত ও প্রযুক্তি : ব্রি এ পর্যন্ত প্রায় ১০টির অধিক লবণাক্ততা সহনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে, যার মধ্যে বোরো মৌসুমের ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৬১, ব্রিধান৬৭, এবং আমন মৌসুমের জন্য বিআর২৩, ব্রিধান৪০, ব্রিধান৪১, ব্রিধান৫৩, ব্রিধান৫৪, ব্রিধান৫৫ ও ব্রিধান৭৩ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া, লবণাক্ত এলাকায় জাতের পাশাপশি বিভিন্ন ধরনের উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে যেমন- সঠিক সময়ে বপন/রোপণ, রোপণের আগে বীজতলায় ঊষবসবহঃধষ সালফার, পটাশ ও দস্তা প্রয়োগ (৬:৬:২ গ্রাম/লিটার), জৈবসার বা ছাই প্রয়োগ করা, জিপসাম ও পটাশ সার ব্যবহার, মাটি ধোয়া ডিবলিং পদ্ধতি অনুসরণ।

খরার সহিষ্ণু জাত ও প্রযুক্তি : আউশ মৌসুমে বিআর২০, বিআর২১, বিআর২৪, ব্রি ধান৪২, ব্রি ধান৪৩, ব্রি ধান৬৫ (বোনা আউশ), আমন মৌসুমের জন্য উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকালের উচ্চফলনশীল ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬৬ এবং ব্রি ধান৭১ জাতগুলো আবাদের পর সহজেই দ্বিতীয় ফসল চাষ করা সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অঞ্চলভেদে খরাসহনশীল জাতগুলো প্রবর্তন করা গেলে কাংক্ষিত উৎপাদন পাওয়া সম্ভব।

বন্যা সহিষ্ণু জাত ও প্রযুক্তি : ব্রি এ পর্যন্ত দুইটি বন্যা সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। উদ্ভাবিত জাতগুলো হলো ব্রি ধান৫১ ও ব্রি ধান৫২। জাত দুটি দুই সপ্তাহ পর্যন্ত পানির নিচে ডুবে থাকলেও বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে কাংক্ষিত ফলন দিতে সক্ষম। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে ৫ দিনের মধ্যে আগাছা পরিষ্কার, ১০ দিন পর বিঘাপ্রতি ৬ কেজি ইউরিয়া ও ৪ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম সার প্রয়োগের ১০ দিন পর পুনরায় একই মাত্রায় ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে।

অলবণাক্ত জোয়ার-ভাটা সহিষ্ণু জাত ও প্রযুক্তি : দীর্ঘকাল গবেষণার পর সম্প্রতি ব্রি উচ্চফলনশীল দুটি জাত ব্রি ধান৭৬ এবং ব্রি ধান৭৭ অবমুক্ত করেছে। এ জাত দুইটি স্থানীয় জাতের চেয়ে হেক্টরপ্রতি ১.৫ টন ফলন বেশি দেয়। ৩৫-৪০ দিনের চারার উচ্চতা স্থানীয় জাতের ন্যায় ৭০-৭২ সেমি. হওয়ায় জাত দুটি বরগুনা ও বরিশাল অঞ্চলে ধান উৎপাদনে অবদান রাখবে। এ ছাড়াও কাক্সিক্ষত ফলন হেক্টরপ্রতি ৫.০ টন পেতে ঘচক ইৎরয়ঁঃঃবব সার ব্যবহার করতে হবে। জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু জাত ও প্রযুক্তি : বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও বৃহত্তর যশোরের বিশাল এলাকা জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত হয়। এই এলাকার উপযোগী জাত বিআর১০, বিআর২৩ ও বিআর৩০। ধান গাছের গোড়ার অংশ পানির নিচে থাকলেও কুশি উৎপাদন করতে সক্ষম।

ভবিষ্যৎ করণীয় : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তবে পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর কৌশল অবলম্বন করতে হবে। যেমন- বৈরী জলবায়ুর (লবণাক্ততা, বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা ও অধিক তাপ সহিষ্ণু) সাথে খাপখাওয়ানোর মতো উচ্চফলনশীল ফসলের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন ও ব্যবহার এবং এগুলোর চাষাবাদ বাড়াতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। নতুন শস্যপর্যায় ও অভিযোজন কৌশলের ওপর ব্যাপক গবেষণা জোরদার করতে হবে। অভিযোজন কৌশল ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে সরকারের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতা বাড়াতে হবে। লবণ সহিষ্ণু, বন্যা সহিষ্ণু, খরাসহিষ্ণু, ঠান্ডা ও তাপ সহিষ্ণু, আলোক অসংবেদনশীল ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন করা। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপখাইয়ে শস্য বিন্যাস ও শস্যপর্যায় অনুসরণ করা। রোগবালাই সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করা। জলবায়ু ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস কৃষকের কাছে দ্রুত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। কৃষিতে তথ্য প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট, মলিকুলার ও বায়োটেকনোলজি প্রযুক্তির ব্যবহার করা। তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, সূর্যালোক নিয়ন্ত্রিত গ্রিন হাউস খামার তৈরি করা। শস্যবীমা চালু করা। সর্জান পদ্ধতিতে সারা বছর ফল ও শাকসবজি চাষ। জলমগ্ন/হাওর এলাকায় পানিতে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা এবং কৃষিতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করা। ভবিষ্যৎ কৃষিকে টেকসই করার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করা প্রয়োজন। পরিশেষে বলা যায়, দেশের প্রতিটি উপজেলায় জলবায়ুর ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করে কৃষি, খাদ্য ও অবকাঠামোসহ সবগুলো বিষয় নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা, গবেষণার মাধ্যমে বৈরী জলবায়ুর সাথে অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তার স্বতঃস্ফূর্ত বাস্তবায়ন ঘটানোর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কৃষির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব। গবেষণা কর্ম, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটেরসহ বিভিন্ন প্রবন্ধ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

লেখক-আব্দুল আলীম নোবেল, (সাংবাদিক ও লেখক)

সমন্বয়ক, পরিকল্পিত কক্সবাজার আন্দোলন

০১৮২৪৪০৩০৮৩,