ডেস্ক নিউজ:

জজ মিয়া‘আমি তো জজ মিয়া নই, জালাল ড্রাইভার। পুলিশ ও মিডিয়ার মাধ্যমে দুনিয়ার সবাই আমাকে জজ মিয়া নামে চেনে। ওইটা তো আমার আসল নাম না। ভোটার আইডি কার্ড অনুযায়ী আমার নাম জালাল উদ্দিন। আমি এখন প্রাইভেটকার চালক। হাসপাতালের রোগী টেনে সংসার চালাই’— রবিবার (২০ আগস্ট) সকালে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে বলছিলেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আলোচিত চরিত্র জজ মিয়া। তিনি আরও বলেন, ‘আমি এখন রায়েরবাগ মা ও শিশু হাসপাতাল থেকে রোগী নিয়ে কুমিল্লার কচুয়ার দিকে রওনা দিয়েছি।’

জালাল উদ্দিন জানান, কিস্তিতে একটি পুরনো প্রাইভেটকার কিনে নিজেই চালান। বহন করেন হাসপাতালের রোগী। এর মাধ্যমে যে টাকা আসে তা দিয়ে মা ও ভাইবোন নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তারা থাকেন নারায়ণগঞ্জে সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক এলাকায়। দুই রুমের বাসায় তিনি ছাড়াও আছেন ছোটবোন খোরশেদা (১৯), ছোটভাই সাইফুল ইসলাম (১৭) ও বৃদ্ধা মা জোবাদা খাতুন।

তবে পরিচয় গোপন রাখার জন্য বারবার বসবাসের জায়গা পরিবর্তন করেন বলে জানিয়েছেন জালাল উদ্দিন। তার কথায়, ‘জজ মিয়া একটি কলঙ্কিত নাম। কারণ এই নাম ব্যবহার করেই তিন পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে ফাঁসাতে চেয়েছিল। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছিল তারা। বিনিময়ে আমার পরিবারকে প্রতি মাসে আর্থিক সহায়তা দিতো। কিন্তু সত্যি কখনও চাপা থাকে না। সব সত্যি প্রকাশের ফলে আমাকে আসামি বানানো ব্যক্তিরাই আসামি হয়ে গেছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, অন্যায়ের শাস্তি দুনিয়াতেই দেখে যেতে পারবো মনে হচ্ছে। তাদের পাপের বিচার দুনিয়াতেই হচ্ছে।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরদিন দণ্ডবিধির ১২০/বি, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩০২, ২০১, ১১৮, ১১৯, ২১২, ৩৩০, ২১৮, ১০৯ ও ৩৪ ধারায় মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এর নম্বর ৯৭। ওই মামলায় গত বছরের আগস্টের আগেই সাক্ষ্য দিয়েছেন জালাল উদ্দিন। তিনি ছিলেন ১০৪ নম্বর সাক্ষী। তার মা ১০৩ ও বোন ১০২ নম্বর সাক্ষী ছিলেন । তারাও সাক্ষ্য দিয়েছেন।

আক্ষেপ নিয়ে জালাল উদ্দিন সবলেন, “ঘটনার সঙ্গে জড়িত না হয়েও জেল খেটেছি। ভিটেমাটি হারিয়েছি। গ্রেফতারের পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তিন কর্মকর্তা আমাকে গ্রেনেড হামলার ঘটনার ভিডিও দেখিয়েছিল। ওই ঘটনা সংশ্লিষ্ট শিখিয়ে দেওয়া কথা মুখস্থ করিয়েছিল। তারা বলেছিল— ‘আমরা তোকে রাজসাক্ষী বানাবো। যেসব কথা শিখিয়ে দেবো, আদালতে সেগুলোই বলবি। যাদের নাম বলতে বলবো তারা সব বড় সন্ত্রাসী। জেল থেকে বের হলে তারা তোকে মেরে ফেলতে পারে। তাই জেল থেকে বের হওয়ার পর তোকে সপরিবারে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবো। সেখানে তুই আরাম-আয়েশে থাকবি।”

জালাল উদ্দিন জানান, কারাগার থেকে বের হওয়ার পর কেউই তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে চায়নি। জজ মিয়া নাম শুনলেই বিব্রত হতো। তাই প্রকৃত নামে বিয়ে করার পরও ঝামেলা শুরু হয়েছে। আট মাস আগে তাকে ছেড়ে চলে গেছেন স্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মামলা খাওয়া মানুষের সঙ্গে ঘর করবে না বলে জানিয়ে গেছে সে। সবাই মনে করে, সরকার বদল হলে আমাকে ফের জেলে যেতে হবে। বছরখানেক আগে পরিচয় গোপন করে চাঁদপুরে বিয়ে করি। কিন্তু কিছুদিন পরই জানাজানি হয়ে যায় গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি ছিলাম। এই নকল পরিচয় গোপন করার জন্যই বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি।’

চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে জালাল উদ্দিন মেজ। তার ভাষ্য, ‘আমার বড় দুই ভাই থাকেন আলাদা। চারজনের সংসার আমাকে চালাতে হচ্ছে। মামলায় জড়িয়ে পড়ায় মা আমার জন্য গ্রামের ভিটেমাটি বিক্রি করেছেন।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশ চলাকালে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের তিন শতাধিক কর্মী। মুহূর্তেই এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয় সেখানে।

এ ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে নাটক সাজায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। ২০০৫ সালের ৯ জুন গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে গ্রেফতার করা হয় জজ মিয়াকে। এরপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে তাকে দিয়েই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়।