ডেস্ক নিউজ:

পশ্চিমবঙ্গের বন্যার জন্য ঢাকা, দিল্লি ও কাঠমান্ডুকে দুষলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। বাংলাদেশ, নেপাল ও ভারতে যখন ব্যাপক বন্যার দেখা দিয়েছে তখনই তৃণমূল নেত্রী এমন মন্তব্য করলেন। বন্যা ঠেকাতে নিজেদের ব্যর্থতার জন্য উল্টো প্রতিবেশী দেশগুলোকে দোষারোপ করলেন তিনি।

পশ্চিমবঙ্গের ‘মনুষ্য সৃষ্ট’ বন্যার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়ী করেই খ্যান্ত হননি মমতা। তিনি বলেন, ‘আত্রাই ও অন্য দুটি নদীর পানি যেন বাংলাদেশ থেকে যথাযথ মাত্রায় উত্তরবঙ্গে প্রবাহিত হয়।’ তার এই অভিযোগের মূলে রয়েছে দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি ও বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি।

মমতার অভিযোগের পর পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দোপাধ্যায় দেখিয়েছেন কিভাবে নেপাল ও বিহার থেকে আসা পানির অতিরিক্ত প্রবাহ উত্তরবঙ্গের বাসিন্দাদের দুর্দশায় ফেলছে। এতে করে লাখ লাখ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। তার অভিযোগ দৃশ্যত আঞ্চলিক নদী সংযোগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যার প্রাথমিক পাঠের চেয়েও গুরুতর, তথ্যভিত্তিক অভিযোগ। তবে তিনি বর্তমান বন্যা ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পেছনের প্রধান কারণটি উল্লেখ করেননি।

সম্প্রতি অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী এলাকাগুলোয় বন্যা দেখা দিয়েছে। তবে দলীয় প্রধানের কাছ থেকে একটি সূত্র নিয়ে সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দোপাধ্যায় সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘মূলত নেপাল ও বিহার থেকে উচ্চ মাত্রার পানি প্রবাহের কারণেই রাজ্যে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার আগে তিনি মালদহসহ অন্য তিনটি জেলার অবস্থা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন।

মজার বিষয় হচ্ছে, ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর অনুযায়ী এবারের বন্যায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২০-এর নিচে। বিহার, নেপাল ও পশ্চিমবঙ্গে এ সংখ্যা যথাক্রমে ৫০, ৫৫ ও ৪৫। প্রতিকূল আবহাওয়া যেন অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতির কারণ না হয় সেটা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার এবং অন্যান্য সংস্থা কী ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে? খুব স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন উঠেছে। এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে, বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য দ্রুত ত্রাণ সরবরাহ এবং অন্যান্য সহায়তা পৌঁছে দিতে পশ্চিমবঙ্গের রেকর্ড উৎসাহব্যাঞ্জক নয়।

কলকাতাভিত্তিক টিভি চ্যানেলগুলোতে দিনের পর দিন দেখানো হচ্ছে, মেদিনীপুর থেকে কোচবিহার পর্যন্ত কয়েক হাজার পানিবন্দি মানুষকে আক্ষরিক অর্থেই খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। তাদের কাছে পর্যাপ্ত খাবার, সুপেয় পানি এবং ওষুধপত্রও পৌঁছায়নি। অধিকাংশ নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নিষ্কাশন চ্যানেলের অভাব, নদীর তীর ও সৈকতের অপব্যবহার, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কারণেই নদীগুলোর এ অবস্থা।

মালদহের বন্যাদুর্গত মোহাম্মদ শফিক বলেন, ‘প্রকৃতির খেয়ালের বাইরে রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট সমাজবিরোধীদের লোভ ও দুর্নীতির জন্য মানুষকে মূল্য দিতে হবে।’

উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ মানুষের কাছেই ত্রাণের পরিমাণ খুবই সামান্য বা একেবারেই দৃশ্যমান নয়। অনেকেই কেবল স্থানীয় এনজিও এবং সংগঠনগুলোর প্রচেষ্টায় বেঁচে আছেন। পশ্চিমবঙ্গের এই দুই অংশেই ত্রাণবহরে ক্ষুধার্থ, উত্তেজিত জনতা কর্তৃক হামলা চালিয়ে লুটপাটের বহু দৃষ্টান্ত আছে। জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারে এটা আরও বেশি ঘটেছে। সেখানে কিছু এলাকায় উত্তেজিত জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। তবে কর্মকর্তারা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

নদীতীরে ভাঙনসহ অন্যান্য সমস্যা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোর বাইরে গিয়ে পিডব্লিউডি-এর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণেও রাজ্য সরকার নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সেচ বিভাগ ছাড়াও ব্রিজ,কালভার্টের মতো বিষয়গুলোও সামনে উঠে এসেছে। প্রায় প্রতিদিনই খবর আসছে কিভাবে পুরনো ব্রিজগুলো ভেঙে পড়ছে। এসব ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণেও দুর্বলতা ছিল। এতে করে উত্তর এবং দক্ষিণের মধ্যে যোগাযোগ ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে স্বাভাবিক রেল চলাচলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

দু’টি সাধারণ উদাহরণ

প্রায় ৪৮ ঘণ্টা আগে ময়নাগুড়ির পানহাতি এলাকায় ইসলামারী নদীতে একটি পুরাতন সেতু ভেঙে পড়েছে। এর ফলে প্রায় ১০ হাজার মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুরাতন ওই সেতুটির কোনও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। শিমুলগুড়ির বন্যাদুর্গত রায়গঞ্জ এলাকায় নিম নদীতে পুরনো একটি বাঁশের ব্রিজ ভেঙে পড়ে। ফলে ওই এলাকার স্বাভাবিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। যদিও এক দশক আগে কাছেই একটি নতুন পাকা ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছিল! কিন্তু জমি নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধের কারণে ব্রিজের দুই পাশে সড়ক নির্মাণ করা যায়নি। ফলে নতুন ওই ব্রিজটি গত ১০ বছরে কখনও ব্যবহৃত হয়নি।

কলকাতার অর্থনীতিবিদ শৌনাক মুখার্জি বলেন, ‘এমন অবহেলার বহু নজির রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে করদাতাদের জন্য ন্যূনতম ত্রাণ বিতরণে সরকারের দক্ষতা বা আগ্রহের অভাব রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এই ধরনের ব্যর্থতা প্রকাশ পায়। অন্যদের দোষারোপ করলেই কলকাতার নিজেদের ব্যর্থতা ছাপিয়ে গোপন থাকে না।’

দুজন গবেষক তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, বাংলাদেশ ও নেপাল বৈশ্বিক উষ্ণতা ও বন্যা সমস্যা সমাধানে যেভাবে সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে পশ্চিম বাংলায় সেরকম উদ্যোগ নেওয়া হয় না। তাদের গবেষণায় দাবি করা হয়, ১৮২১ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে পশ্চিম বাংলার ছোট ছোট নদী ও খাঁড়িগুলো বড় নদীর নালা হিসেবে কাজ করতো। ১৯৫০ সালের পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষের সংখ্যা ও চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ছোট ছোট নদীর অবৈধ দখল এবং অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের কারণে পানি প্রবাহ ধ্বংস হয়। এমনকি বৃহত্তর কলকাতায়ও পানি প্রবাহের জন্য কোনও খালও অবশিষ্ট নেই।

পরিবেশবাদীদের মতে, কলকাতার বেহালা এবং হাওরার আমতায় বেপরোয়াভাবে ও রাজনীতির প্রভাব খাটিয়ে পরিবেশ ধ্বংসের ফলই বন্যার প্রধান কারণ। মূলত ভোট পেতেই এমন প্রভাব খাটানো হয়।