ডেস্ক নিউজ:
তিন কারণে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। এর একটি কারণ প্রাকৃতিক, অপর দুটি পরিস্থিতিজনিত। প্রথম প্রাকৃতিক কারণ, অতিবৃষ্টি ও বন্যা। অতিবৃষ্টি আর বন্যার কারণে অনেক আড়তে বৃষ্টির পানি জমে গেছে। এতে মজুদকৃত পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। এতে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। অপরদিকে ভারতেও প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় রফতানিকারক দেশ হওয়ায় এই বৃষ্টি ও বন্যা আমদানিতেও প্রভাব ফেলছে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, আসন্ন কোরবানির ঈদ। এ সময় পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয় বলে সে সুযোগটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে ব্যবসায়ীরা। ফলে প্রতিদিনই বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে মিশর ও পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানি করছে সরকার। ইতোমধ্যে আমদানি করা পেঁয়াজের জাহাজ দেশে এসে পৌঁছালেও বন্দরে ভিড়তে পারছে না জাহাজ জটের কারণে। পেঁয়াজের দাম বাড়ার এটি পরিস্থিতিজনিত তৃতীয় কারণ।
রাজধানীর বাজারগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ৩০/৩২ টাকা কেজি দরের দেশি পেঁয়াজ ১৫ দিনের ব্যবধানে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে। স্থান ভেদে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রির অভিযোগও পাওয়া গেছে। পেঁয়াজের এই দাম বাড়ার জন্য পাইকারি বিক্রেতা ও আড়তদার একে অপরকে দুষছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আড়তদাররা দাম বাড়িয়েছে পেঁয়াজের। অপরদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন বেশি দাম দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে, তাই কম দামে বিক্রির সুযোগ নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোরবানির ঈদের সময় এলেই পেঁয়াজের বাজার প্রতিবছর অস্থির হয়ে ওঠে। কোরবানির সময় দেশে পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হয় বলে এই সুযোগ নেয় ব্যবসায়ীরা। ফলে প্রতিবছরের মতো এবারও স্বাভাবিক নিয়মে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। তবে এবছর এর সঙ্গে বাড়তি যুক্ত হয়েছে বৃষ্টি। অতি বৃষ্টিতে দেশেও প্রচুর পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে এবং হচ্ছে। অনেক আড়তে পানি উঠে গেছে। ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। অপরদিকে, পেঁয়াজের বড় রফতানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত ভারতেও বৃষ্টি হচ্ছে। সেখানেও অতিবৃষ্টির ফলে পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। ফলে আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়ে ৪৫ টাকায় উঠেছে। তাই এবছর পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি অনেকটাই অস্বাভাবিক।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি হিসাবে দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছরে ২০ থেকে ২২ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা আছে। রমজান মাস ও কোরবানিকে কেন্দ্র করে এ চাহিদা বেড়ে যায়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, এই চাহিদার বিপরীতে বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ১৭ থেকে ১৮ লাখ মেট্রিক টন। বাকিটা আমদানি করতে হয়। যা বেশিরভাগই পাশের দেশ ভারত থেকে আমদানি হয়ে আসে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে ব্যবসায়ীরা মনে করেন, পেঁয়াজের চাহিদার ৬০ ভাগ দেশীয় পেঁয়াজ দিয়ে পূরণ হয়। বাকিটা আমদানি করে মেটাতে হয়।
বরাবরই বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার অলিখিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ভারত। মোট চাহিদার ২২ লাখ টনের মধ্যে দেশে ১৮ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। চাহিদার ঘাটতি মাত্র ৪ লাখ টন। এই চার লাখ টন পেঁয়াজই পাশের দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর এই ৪ লাখ টন পেঁয়াজই বাংলাদেশে উৎপাদিত ১৮ লাখ টনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তর করে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজার চলে আমদানি করা ৪ লাখ টন পেঁয়াজের মর্জি অনুসারে। ভারত থেকে ৫ লাখ টন নয়, মাত্র ১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করার প্রয়োজন হলেই দেশের বাজারের চিত্র পাল্টে যায়। ওই এক লাখ টনের দাম গিয়ে পড়ে উৎপাদিত ১৮/২০ লাখ টনের ওপর।
এদিকে, দেশে গড়ে প্রতি মাসে পেঁয়াজের চাহিদা এক লাখ ১০ হাজার টন। এর মধ্যে নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে পেঁয়াজের চাহিদা বেশি থাকে। এছাড়া রমজান মাস ও কোরবানির সময় পেঁয়াজের দেড় থেকে দুই লাখ টনের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। এ চাহিদাকে পুঁজি করে সক্রিয় ওঠে সিন্ডিকেট। এবারের ঈদুল ফিতরে পেঁয়াজ নিয়ে তেমন কোনও কারসাজি না হলেও কোরবানি ঈদকে টার্গেট করেছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। দেশে উৎপাদন, আমদানি ও চাহিদা হিসাব করলে এখনও দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজের মজুদ থাকার কথা।
গত বছর সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপে পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল থাকলেও এ বছর এরই মধ্যে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৫ টাকা। বাংলাদেশের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এ বছর ভারতেও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। এতে ভেলোরের অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। সেদেশেও বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। আর এরই প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বাজারে।
এ বছর দেশে পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়েছে। এর পরেও কেন বাড়ছে পেঁয়াজের দাম- জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব শুভাশীষ বসু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘এটি সাময়িক। কয়েকদিনের মধ্যে কমে যাবে।’
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পেঁয়াজের দাম কমেনি। বরং বেড়েছে এটি জানালে তিনি বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে রাস্তা ভেঙে গেছে, ‘এতে ট্রাক চলছে না। তাই হয়তো পেঁয়াজ পরিবহনে সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে হয়তো বাড়তে পারে পেঁয়াজের দাম।’
রাজধানীতে বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি ভারতীয পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০-৬০ টাকা পর্যন্ত। আর দেশি পেয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। কোরবানি যতোই এগিয়ে আসছে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, আড়তদাররা বেশি দামে বিক্রি করছেন। আমাদেরও বেশি দামে কিনে আনতে হচ্ছে। তাই বেশি দামে বিক্রি করা ছাড়া আমাদেরতো কোনও রাস্তা নাই। পাইকারি মূল্য বেশি হলে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়বেই। যার প্রভাব ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পেঁয়াজের সংকট কাটিয়ে তুলতে মিশর ও পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ভিড়েছে পেঁয়াজবাহী জাহাজ। এই জাহাজ থেকে পেঁয়াজ দ্রুত খালাসের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমদানিকৃত পেয়াজ বাজারে এলেই কমে যাবে দাম। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিমগুলোও খতিয়ে দেখছে।’ তিনি বলেন, ‘কেউ যদি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অযৌক্তিক পেঁয়াজের দাম বাড়ায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানা গেছে, পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ ও আমদানি মূল্য বিবেচনায় নিলে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বাবদ ব্যবসায়ীদর খরচ পড়েছে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ টাকা। দেশে বর্তমানে পেঁয়াজের যে মজুদ রয়েছে তা দিয়ে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মেটানো যাবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব শুভাশীষ বসু বলেন, পেঁয়াজের দাম কী কারণে বাড়ছে সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। কোরবানির সময় মসলাজাতীয় পণ্যের বাড়তি চাপ থাকে। কিন্তু পেঁয়াজের দাম বাড়ার এখন কোন কারণ নাই।
এ প্রসঙ্গে রাজধানীর কাওরানবাজারের একজন ব্যবসায়ী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বাজারে দেশি পেঁয়াজ আছে তবে তা পর্যাপ্ত নয়। দেশি পেয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলে দাম এতো বাড়তো না। দেশে প্রতিদিন বৃষ্টি হচ্ছে। এ বৃষ্টিতে মজুদকৃত পেঁয়াজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
৩ কারণে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম
পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।