বিদেশ ডেস্ক:
ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনআইব্যাকস নামের নিজস্ব প্রযুক্তি কোম্পানির মাধ্যমে জনপ্রিয় অনলাইন শপিং সাইট ই-বেতে কম্পিউটারের প্রিন্টার বিক্রির নাটক সাজাতো সিরিয়ায় নিহত বাংলাদেশি জঙ্গি সাইফুল হক সুজন। আর পেপাল অ্যাকাউন্টে ওই প্রিন্টারের দাম বিনিময় হতো। আসলে প্রিন্টার বিক্রির আড়ালে ব্রিটেন থেকে জঙ্গি অর্থায়নের টাকা সংগ্রহ করত সে, যে টাকা এসেছে বাংলাদেশেও। ফেডারেল আদালতে এফবিআইয়ের দেওয়া এক এফিডেভিটের বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল দাবি করেছে, এভাবেই বাংলাদেশে জঙ্গি অর্থায়ন হতো।

সন্দেহভাজন এক আইএস সদস্যের বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা অর্থপাচার ও জঙ্গি অর্থায়নের ওই নেটওয়ার্ক খুঁজে পান। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, দেড় বছর আগে মেরিল্যান্ডে অভিযান চালিয়ে মোহাম্মদ এলশিনাওয়ি নামের ৩০ বছর বয়সী এক সন্দেহভাজন আইএস সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই তদন্তকারীরা জঙ্গিদের অর্থ পাচার নেটওয়ার্কের ‘ক্লু’ পান।

দীর্ঘদিন নজরদারির পর ২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর এলশিনাওয়িকে গ্রেফতারর করে এফবিআই। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তার বিরদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বাল্টিমোরের ফেডারেল গ্র্যান্ড জুরি। সেখানে বলা হয়, এলশিনাওয়ি ই-বে’র মাধ্যমে প্রিন্টার বিক্রির নাটক সাজিয়ে পেপালের মাধ্যমে আইএসের নেটওয়ার্ক থেকে অর্থ নেন। ওই অর্থ সন্ত্রাসী হামলায় ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল।

এফবিআইয়ের দেওয়া এফিডেভিটের বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল লিখেছে, এই পদ্ধতিতেই অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের জঙ্গি অর্থায়ন হয়ে থাকে। একই পদ্ধতি ব্যবহার করে আইএস নেটওয়ার্ক যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশেও টাকা পাঠিয়েছে। আর এর পেছনে ছিলেন আইএসের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ‘বাংলাদেশি কম্পিউটার প্রকৌশলী’ সাইফুল হক সুজন। আইএসের ওই নেটওয়ার্কে যুক্ত বেশ কয়েকজন পরে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে গ্রেফতার বা নিহত হয় বলে এফবিআইয়ের এফিডেভিটে উল্লেখ করা হয়েছে।

এফবিআইয়ের নথি অনুযায়ী, ওই সময়ে আইএসের কম্পিউটার অপারেশনস বিষয়ক পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত ছিল সুজন। সেই সুজনের প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ প্রযুক্তি কোম্পানি আইব্যাকসের মাধ্যমে ওই আর্থিক নেটওয়ার্কটি পরিচালিত হতো। ওই নথি অনুযায়ী, বাংলাদেশে সুজনের কোম্পানির একটি শাখা রয়েছে। তুরস্কেও ওই কোম্পানির একটি শাখা স্থাপন করছিল সুজন। তবে সুজন কবে আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া গিয়েছিল, তা স্পষ্ট করে জানা যায়নি।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল লিখেছে, ওয়েবসাইট তৈরি করে দেওয়া পাশাপাশি ‘প্রিন্টার কনফিগার করে দেওয়ার কাজ’ও করত সুজনের কোম্পানি আইসব্যাক। কিন্তু ওই কোম্পানির নামে ১৮ হাজার ডলারে কানাডার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে মিলিটারি গ্রেড সার্ভেইল্যান্স ইকুইপমেন্ট কেনা হয়েছিল বলে তথ্য পেয়েছেন এফবিআইয়ের তদন্তকারীরা। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানিতে তারা আড়িপাতা সরঞ্জাম খুঁজে বের করার যন্ত্রপাতি কেনার অর্ডার দিয়েছিল, যা পাঠানোর কথা ছিল তুরস্কে।

এফবিআইয়ের এফিডেভিটে বলা হয়েছে, আইএসের এই নেটওয়ার্ক থেকে মোট ৮,৭০০ ডলার পেয়েছিলেন মোহাম্মদ এলশিনাওয়ি। এর মধ্যে পেইপ্যালের মাধ্যমে পাঁচটি পেমেন্ট তিনি পেয়েছিলেন সুজনের কোম্পানির কাছ থেকে। এফবিআইএয়ের তথ্য অনুযায়ী, এলশিনাওয়ি ওই অর্থ খরচ করেন একটি ল্যাপটপ, একটি সেলফোন ও ভিপিএন কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক কেনার পেছনে। আইএস নেটওয়ার্কে যোগাযোগের জন্য ওইসব যন্ত্রপাতি তিনি ব্যবহার করতেন।

ওই নথি থেকে আভাস পাওয়া গেছে, জঙ্গি নেটওয়ার্কটির অন্য সদস্যরা ব্রিটেন ও বাংলাদেশেও গ্রেফতার হয়েছে। সেইসঙ্গে এও জানা গেছে, এখন পর্যন্ত আইএসের সম্ভাব্য যে কয়টি আর্থিক নেটওয়ার্ক শনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে এটি একটি। ওই নেটওয়ার্কের সামরিক সরঞ্জামাদি কেনার কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল, এমন কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও গ্রেফতার হয়েছে; কিংবা ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এক সমন্বিত হামলায় নিহত হয়েছে। এ ব্যাপারে জানাশোনা রয়েছে এমন এক ব্যক্তিকে উদ্ধৃত করে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর একটি ড্রোন হামলায় সুজন নিহত হয়।

যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর সিরিয়ায় আইএসের কথিত রাজধানী রাকার কাছে ড্রোন হামলায় নিহত হয় সুজন। যুক্তরাজ্যে কম্পিউটার প্রকৌশলে পড়াশোনা করা এই বাংলাদেশি ওই সময় আইএসের কম্পিউটার অপারেশন বিভাগের প্রধান ছিল বলে যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীদের ভাষ্য।

অ্যাপ ও ওয়েবসাইট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আইব্যাকস টেকনোলজিসের মূল কার্যক্রম চলত যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ থেকে। বাংলাদেশ ছাড়াও ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, জর্ডান, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রে এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা ছিল। ওই ব্যবসার আড়ালে সুজন অর্থপাচারে যুক্ত ছিল বলে দাবি করছেন তদন্তকারীরা।

আইব্যাকসের মাধ্যমে সুজন কয়েক লাখ পাউন্ড ঢাকা হয়ে সিরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন বলে সে সময় ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছিল যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রগুলো। এবার বাংলাদেশে জঙ্গি অর্থায়নের খরব জানা গেল।