ডেস্ক নিউজ:

আশির দশক, রাজধানীর ইলিশিয়াম হোটেলে সামান্য একটি ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হলে চারজন মিলে হত্যা করে এক বন্ধুকে। তোলপাড় হয় সারাদেশে, বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন। তিন দশক আগের সেই ঘটনার বিচার হয়েছিল বটে, কিন্তু এখনও বদল হয়নি পরিস্থিতি। বরং এখন নির্যাতনের ধরণ বদলেছে। বেড়েছে ভয়াবহতা। বন্ধুর নামে কেবল নয়, যাকে জীবনসঙ্গী করার পরিকল্পনা করছেন, তার কাছেও ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে নারীকে। এমনকি কিশোর না হয়ে ওঠা ছেলে বন্ধুদের হাতেই ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হচ্ছে কিশোরীরাও।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের এক ছাত্রীর সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় বাদশা নামে এক যুবকের। চিকিৎসার জন্য ওই ছাত্রী চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহীতে এসে ফোন করেন তার ফেসবুক বন্ধু বাদশাকে। এ সময় বাদশা তাকে ডেকে নিয়ে যান নগরীর গোরহাঙ্গা এলাকায়। দুপুরে খাবারের কথা বলে ওই ছাত্রীকে নওদাপাড়া এলাকার গ্রিন গার্ডেন নামের একটি গেস্টহাউসে নিয়ে যান। সেখানে একটি কক্ষে আটকে রেখে প্রথমে বাদশা ও পরে নাহিদ নামে আরও এক যুবক ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন।
ঢাকার বনানী রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনায়ও পরিচিত বন্ধুদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার দিন সাফাত আহমেদ তার ‘জন্মদিনের’ অনুষ্ঠানের কথা বলে রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া পূর্ব পরিচিত দুই তরুণীকে। ঘটনার শিকার ওই তরুণীদের একজনের মামলায় অভিযোগ করা হয়, পরিবেশ ভালো না লাগায় তারা তিন বান্ধবী ও তাদের চিকিৎসক বন্ধু চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে সাফাত-নাঈমরা তাদের গাড়ির চাবি কেড়ে নেয়। এরপর অভিযোগকারী দু’জনকে হোটেলের একটি কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করে এবং পরদিন সকাল ১০টায় তাদের ছেড়ে দেয়।
কেবল নারী নির্যাতন নয়, বন্ধুদের হাতে হত্যার শিকার হতে হয়েছে যে আদনানকে, সে বন্ধুর ডাকেই সারা দিয়েছিল। বিত্তশালী পরিবারের সন্তান আদনান যাদের বন্ধু ভেবেছিল, তারা অনেকেই বুঝেনি বন্ধুত্বের মানে। গতবছর রাজধানীর উত্তরায় আদনান কবীর নামের এক স্কুলছাত্র বন্ধুদের পিটুনিতে নিহত হলে, আবারও নতুন করে মনোবিশ্লেষকরা ভাবতে শুরু করেন, সমাজের কোন অংশে ফাঁক থেকে যাওয়ায় এই অবক্ষয়। সমাজগবেষক ও আইনজীবীরা বলছেন, ভার্চুয়াল যুগে বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক থাকা উচিত। আগে বন্ধুদেরকে পরিবারের সদস্যরাও চিনতো এবং এক ধরনের দায়বদ্ধতা কাজ করতো।
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখনকার সমাজ অনেক বেশি বিশৃঙ্খল ও বিচ্ছিন্ন। আগে ছোটবেলা থেকেই পাড়া মহল্লায় বন্ধুত্ব তৈরি হতো নানা ঘাত -প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। এখন পাড়া-মহল্লা কালচার না হওয়ায় স্কুলকেন্দ্রিক বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু সেখানে বন্ধুত্বটি সামনে এগোতে পারে না। কারণ পড়ার অনেক চাপ। ফলে সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আর এই বিচ্ছিন্নতা থেকে তারা ফেসবুক বা টেকনোলজি নির্ভর বন্ধুত্বে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে মানুষ পর্দার আড়ালে থাকে বলে তাদের চেনা যায় না। যেখানে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক হয় না, সেখানে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকেই।’
বন্ধু কে হবে, সেটি প্রথমত বাবা-মাকে দেখেই সন্তান শেখে বলে মনে করেন উত্তরা কালচারাল সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক রবিউল মাহমুদ ইয়ং। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভালো বন্ধু বেশি হওয়ার কথা না। আমরা দেখি, এখন সবাই কথায় কথায় একজন আরেকজনকে ‘বন্ধু’ পরিচয় দিচ্ছি। ভুলে গেলে চলবে না, অসাম্প্রদায়িক মানবিক সম্পর্ক হিসেবে বন্ধুত্বকে এগিয়ে নেওয়ার সময় ও জায়গা হলো স্কুল। এর পরবর্তীতে সে কিভাবে বড় হবে, সেটা অভিভাবকদের দায়িত্ব।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাবা-মা কোন বন্ধুদের সঙ্গে কিভাবে সময় কাটাচ্ছেন সেটা ছেলেমেয়েদের প্রভাবিত করতে বাধ্য।’
মনোচিকিৎসক মেখলা সরকার বলেন, ‘আমাদের সমাজে এধরনের ঘটনা ঘটছে এবং ঘটার পর আমরা মেয়েটিকে আরও দোষারোপের মধ্যে ফেলছি যখন, তখন সে আর কোনোদিন ‘বন্ধু’কে বিশ্বাস করবে না। এমনকি অন্য অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের ‘বন্ধু’দের বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কিন্তু নির্বাচন করে সবসময় বন্ধু হয় তাও কিন্তু না। বন্ধু হয়ে যায়। সে কারণে আমাদের যেটা যাচাই করতে ও শিখতে হবে সেটা হলো- কখন বন্ধুত্ব ভাববো।’