বাংলাট্রিবিউন:
বি. চৌধুরীর বাসায় বৈঠকবিকল্প ধারা বাংলাদেশের সভাপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাসায় যৌথ আন্দোলন গড়ে তুলতে চারটি রাজনৈতিক দলের লিয়াজো কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে। লিয়াজো কমিটির বাকি তিনটি দল হলো— বিকল্প ধারা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ও গণফোরাম। প্রতিটি দল থেকে একজন করে প্রতিনিধি থাকবেন লিয়াজো কমিটিতে। বুধবার (২ আগস্ট) রাতে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাসায় আড়াই ঘণ্টার এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বৈঠকে অংশ নেওয়া একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে বৈঠকে অংশ নেওয়া গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আপাতত বৈঠক ডাকা, কর্মসূচি প্রণয়ন করা— এসব কাজ সমন্বয় করতে বলা হয়েছে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে। এগুলো তো কাউকে না কাউকে করতেই হয়। তবে এটা ফরমাল না, ইনফরমাল।’
বৈঠক সূত্র জানায়, জোটের নামকরণ, কর্মসূচিসহ বাকি বিষয়গুলো সব দলের অংশগ্রহণে সিদ্ধান্ত হবে। তবে ঠিক কবে নাগাদ জোটের আত্মপ্রকাশ হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি।
যুগপৎ আন্দোলনের আলোচনা
সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্প ধারা সভাপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর (বি. চৌধুরী) আমন্ত্রণে বারিধারা ১২ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাড়িতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশ নেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, জেএসডি সেক্রেটারি আব্দুল মালেক রতন, বিকল্প ধারার মাহী বি চৌধুরীসহ দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের)।
বৈঠকে কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের প্রতিনিধিদের আসার কথা থাকলেও দলটির কেউ এই বৈঠকে অংশ নেননি। বৈঠকে যত দ্রুতসম্ভব মাঠ পর্যায়ে কর্মসূচি দেওয়া এবং বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলোর যৌথ কর্মসূচি দেওয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বারিধারায় ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাড়ি, তৃতীয় তলায় অনুষ্ঠিত হয় বৈঠকটিবৈঠকে অংশ নেওয়া অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া চলছে, তারই অংশ হিসেবে আমরা মিলিত হয়েছিলাম। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমরা মতবিনিময় করেছি। দেশের মানুষ বিএনপিকে নিয়ে হতাশ হয়েছে, সরকারে ওপরও আস্থা হারিয়েছে। এ কারণে আমরা এই দুই দলের নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে একটি বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।’
বৈঠক সূত্র জানায়, আলোচনায় জোট গঠনের বিষয়টিকে আড়াল করে যুগপৎ বা যৌথভাবে কর্মসূচি প্রণয়নের বিষয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে কোনও কোনও নেতা নির্বাচনকে সামনে রেখে এই জোট কিনা, এমন প্রসঙ্গ তুললেও তা আলোচনায় নলেও প্রাধান্য পায়নি। বি চৌধুরী এই সরকারের আচরণ, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসূচির ওপর জোর দেন। তার এই আলাপে সায় দেন বাকি নেতারা।
এ বিষয়ে সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘জনসম্পৃক্ত এমন অনেক ইস্যু আছে, যেগুলো নিয়ে বিএনপি কাজ করছে না। কিন্তু এসব ইস্যুতেই এখন মাঠে থাকা দরকার। তাই আমরা মাঠে নামার পরিকল্পনা করছি।’
প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘কিভাবে ও কত দ্রুত কর্মসূচি দেওয়া হবে এবং আমরা কিভাবে যৌথভাবে কর্মসূচি পালন করব, তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বৈঠকে।’
বৈঠক নিয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা দুই জোটের বাইরে একটি বিকল্প গড়ার চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছি। আজকের বৈঠক অনেকটাই ফলপ্রসূ হয়েছে। নির্বাচন, সরকার, বিরোধী দল, আগামী দিনে কী হতে পারে— এমন অনেক প্রসঙ্গ নিয়েই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।’
বৈঠক সূত্র জানায়, আলোচনা অনেকটাই জোট গঠনের প্রক্রিয়ার প্রায় চূড়ান্ত দিকেই রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তবে কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকীর অনুপস্থিতি ও জি এম কাদেরের উপস্থিতির কারণে বিষয়টি চূড়ান্ত রূপ পায়নি। তবে এর আগে গত ১৩ জুলাই আ স ম আব্দুর রবের বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর বি. চৌধুরীর বাসার বৈঠকে অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়েছে। যদিও গত সপ্তাহে সিপিবি-বাসদ ও বাম মোর্চা আরেকটি জোটের প্রক্রিয়া শেষ করায় আপাতত সম্ভাব্য এই জোটটি যুগপৎ কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘বাম মোর্চা, সিপিবি-বাসদ তো ঐক্য করেছে। আমরাও যুগপৎ কর্মসূচি দেওয়ার চেষ্টা করব।’
তবে যুগপৎ আন্দোলন নির্বাচনকে টার্গেট করে কিনা, এমন প্রশ্নে বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন সিনিয়র নেতা বলেন, ‘না, এখনও আমরা সেভাবে ভাবছি না। এটা পরে ভাবা যাবে।’ তবে সূত্র জানায়, ঘটমান ঘটনাগুলোকে ইস্যু করে যুগপৎ কর্মসূচি দেওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা হয়েছে বৈঠকে।
বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের পাশে জি এম কাদেরজি এম কাদের ও জাপা প্রসঙ্গ
বি. চৌধুরীর বাসার বৈঠকে অংশ নেন সংসদে বিরোধী দল ও মন্ত্রিসভায় থাকা জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। বৈঠকে দেশের পরিস্থিতির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক্ষেত্রে জাপা কী ভূমিকা রাখতে পারে, এমন প্রস্তাবে জি এম কাদের বৈঠকে জানান, তিনি এরশাদের নেতৃত্বাধীন দলে আছেন। তাদের প্রস্তাব ও আলোচনা দলের চেয়ারম্যানকে জানাবেন এবং প্রয়োজনে তিনি প্রেসিডিয়ামের আলোচনায় তুলবেন। জি এম কাদের বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তিনি দলের চেয়ারম্যান এরশাদের অনুমতি নিয়েই বি. চৌধুরীর বাসায় দাওয়াতে গিয়েছিলেন।
তবে সুব্রত চৌধুরী দাবি করেন, জিএম কাদের অতিথি হিসেবে বৈঠকে উপস্থিত হয়েছিলেন। মাহমুদুর রহমান মান্না এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘কাদের সাহেব (জি এম কাদের) এসেছেন বদরুদ্দোজা চৌধুরীর গেস্ট হিসেবে।’
সূত্র জানায়, বর্তমান চলমান রাজনৈতিক ধারা পরিবর্তন আনতে চায় বৈঠকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিকদলগুলো। এ বিষয়টি জানিয়ে নতুন ধারার রাজনৈতিক চর্চা শুরু করা যায় কিনা, জাপার কো-চেয়ারম্যানের কাছে এমন প্রশ্ন তোলা হয়।
পরে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য বদরুদ্দোজা চৌধুরী আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি তার বাসায় গিয়েছিলাম। ওনারা অনেক বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কিভাবে একটি কমন প্ল্যাটফর্ম থেকে কর্মসূচি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে কথা বলেছেন। জাতীয় পার্টি অংশ নিতে পারে কিনা, এসব বিষয় জানতে চেয়েছেন। যুগপৎভাবে কোনও কর্মসূচি দেওয়া যায় কিনা, এসব বিষয়ে কথা হয়েছে। আমিও মতামত দিয়েছি। বলেছি, সবকিছুই নির্ভর করছে পার্টির চেয়ারম্যানের ওপর। তিনি ও দল যা ভালো মনে করবে, তাই করব।’
জি এম কাদের বলেন, ‘বি. চৌধুরীর আগের যে প্রোগ্রাম ছিল, তেমন প্রোগ্রাম দেশবাসী চায়। বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে এককভাবে না করে, সবাই মিলে একটা ধারা তৈরি করতে পারি কিনা সেটা নিয়ে কথা হয়ৈছে। তবে জোট করার বিষয়ে কোনও কথা হয়নি। যারা আসতে চায়, তারা আসবেন।’
এদিকে জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) সকালে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংবাদ সম্মেলনে দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি, বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনা এবং দুই উপাচার্যের বিরোধের জের ধরে তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমানের চোখ হারানোর বিষয়ে বক্তব্য রাখার কথা রয়েছে তার।’
কাদের সিদ্দিকী এলেন না, কেন?
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে কাদের সিদ্দিকীর আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি টাঙ্গাইলে আছেন বলে আসতে পারেননি। বৈঠকে বি. চৌধুরী নিজেই এ তথ্য জানিয়েছেন। যদিও এ বিষয়ে জানতে চেয়ে দলটির যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকীকে কল করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাড়ির গেটযেমন ছিল রাতের বারিধারা
অন্যান্য সাধারণ রাতের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তায় ঘেরা ছিল বারিধারা কূটনৈতিক এলাকা। এই এলাকার ১২ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাড়িটিই সাবেক রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরীর। এই বাড়ির তৃতীয় তলায় বসার ঘরে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে বিকল্প রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার বৈঠক।
বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী তাহের মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বুধবার রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে নেতারা বাসায় চলে আসেন। রাত সাড়ে ১১টার সময় তারা বের হয়ে যান।’
বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার সময় বারিধারার ১২ নম্বর সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দু’য়েকজন গোয়েন্দা সদস্য ও কয়েকজন গণমাধ্যমের কর্মী ছিলেন। আর পুরো এলাকায় ছিল সুনসান।
বৈঠকে শরিক হওয়া সুব্রত চৌধুরী জানান, বি. চৌধুরীর বাড়িতে তারা রাত ৯টার দিকেই যান। সেখানে আলোচনার ফাঁকে-ফাঁকে আড্ডাও হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি আমন্ত্রিতদের মাছ-মাংস ও ভাত এবং মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করেন বলে জানান গণফোরামের এই নেতা। তিনি এও জানান, বৈঠকে সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ জন নেতা অংশ নেন।
প্রসঙ্গত, গত ১৩ জুলাই আ স ম রবের উত্তরার বাসায় বৈঠক করেছিলেন এসব দলের নেতারা। জেএসডি সভাপতির বাসার বৈঠকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বদিউল আলম মজুমদারও ছিলেন।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।