বাংলাট্রিবিউন:

রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিল- দুই মাসে ১০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে হামে। প্রায় প্রতি মাসেই হামে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে এ হাসপাতালে। এছাড়াও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ত্রিপুড়া পাড়ায় চলতি জুলাই মাসেই হামে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১০ শিশু, হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে আরও ৫ জনকে। চিকিৎসকরাই বলছেন, শিশুদের সংক্রামক রোগের মধ্যে হাম সবচেয়ে ভয়াবহ হলেও এ নিয়ে জনসচেতনতার অভাব রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগও পর্যাপ্ত নয়। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় হাম রোগের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জুলাই মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চলতি বছর দুই হাজার ৪৩১ জন হাম রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল এক হাজার ৬৭। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, হামের প্রকোপে আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত হাম আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল অষ্টম।
দেশে হাম পরীক্ষা করা জাতীয় জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান থেকে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সেখানে হামের নমুনা পরীক্ষার জন্য মানুষজন আসছেন। এর মধ্যে কেবল রাজধানী থেকেই আসছে প্রতিদিন ২০ জনের মতো। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান জানান, প্রায় প্রতিদিনিই সেখানে হাম শনাক্তের জন্য রোগীরা আসছেন।
সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরা পাড়ায় টিকাদান কর্মসূচি না থাকার কারণেই হামে আক্রান্ত হয়ে ৯ শিশুর মৃত্যুর হয়েছে বলে মনে করে খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতর। জ্বর, শরীরে ফুসকুড়ি, কাশি, পাতলা পায়খানাসহ অন্যান্য উপসর্গে আক্রান্ত হয়ে গত ৮ থেকে ১২ জুলাইয়ের মধ্যে ত্রিপুরা পাড়ার ৯ শিশু মারা যায়। প্রথমে রোগটিকে অজ্ঞাত বলে সিভিল সার্জন ঘোষণা করলেও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) আক্রান্ত শিশুদের রক্ত ও প্রস্রাবের নমুনা পরীক্ষা করে জানানো হয়, এই শিশুরা হামে আক্রান্ত হয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে বলা হয়েছে, ত্রিপুরা পাড়ায় টিকাদান কর্মসূচি না থাকার পাশাপাশি তীব্র অপুষ্টির কারণেই রোগটি মহামারী হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। পরে গত ২৪ জুলাই মৃত্যু হয় আরও এক শিশুর। গত ২৭ জুলাই হামে আক্রান্ত হলে আরও পাঁচ শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে জানা যায়,সারাদেশে প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ডভিত্তিক মাইক্রোপ্ল্যান অনুযায়ী টিকাদান কর্মসূচি পালিত হয়। ২০১৫ সালের জরিপ অনুযায়ী, ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ শিশু টিকাদান কর্মসূচির আওতায় থাকলেও বাকি ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাইরে থেকে যাচ্ছে। সীতাকুণ্ডের শিশু মৃত্যুর ঘটনার পর দেশের সব ওয়ার্ডের টিকাদান মাইক্রোপ্ল্যান নতুন করে পর্যালোচনা করা হবে বলেও জানানো হয় অধিদফতর থেকে।
তবে সীতাকুণ্ডের ঘটনার পর ৯টি পাহাড়ে বসবাতরত ৮৫টি বাড়ির ৩৮৮ জন সদস্যের জীবনাচরণকেও দায়ী করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অধিদফতর থেকে বলা হয়েছে, তারা কারও সঙ্গে মেলামেশা করে না, আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি নিতেও অনাগ্রহ রয়েছে তাদের। যদিও শিশুমৃত্যুর পর কর্তব্যে অবহেলার কারণে অধিদফতর ওই এলাকার ছয় স্বাস্থ্য মাঠকর্মীকে অন্যত্র বদলি করে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত দুই মাসে বেশ কয়েকটি হামের রোগী আমরা পেয়েছি,রিপোর্টও দিয়েছি।’ এ রোগটি ছড়ানোর পেছনে পরিবারের অসচেতনতাও দায়ী বলে মন্তব্য করেন তিনি। অধ্যাপক ইফফাত আরা বলেন,‘শিশুদের যখন টিকা দেওয়া হয়, তখন পরপর তিনটি টিকা দেওয়া হয়। কিন্তু হামের টিকা দেওয়া হয় ৯ মাস পেরিয়ে ১০ মাসের সময়ে-যেটি বেশ খানিকটা সময়ের বিরতি নিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশের অভিভাবকরা সেরকম সচেতন হয়ে ওঠেননি। আর হামকে এখনও ততোটা মারাত্মক বলে তারা মনে করেন না। কিন্তু হাম থেকে কত ধরনের মারাত্মক জটিলতা হতে পারে সে নিয়ে তারা ওয়াকিবহাল নন।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন,‘দেশের শতভাগ শিশু অবশ্যই সব টিকা পায় না। ৮২ দশমিক ৫ দশমিক শিশু প্রথম ধাপে টিকা পেলেও অনেকে আবার দ্বিতীয় রাউন্ডে গিয়ে ড্রপ আউট হয়ে যায়, আর যে অংশটা বাকি থাকে সেটা সংখ্যার দিক থেকে মোটেও কম নয়।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যাটারনাল, নিউনেটাল, চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলোসেন্স হেলথ প্রকল্পের পরিচালক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সারাদেশে ১০টি রোগে ১১টি টিকা দেওয়া হয়। এরপরও যদি এভাবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে, তাহলে সেটা খুবই দুঃখজনক।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছি। সব সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়েছি। গতকাল চিঠি দিয়ে বলেছি, নতুন করে মাইক্রোপ্ল্যান দিতে, যেন দেশের কোথাও একটি শিশুও টিকাদান কর্মসূচির বাইরে না থাকে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পর্যালোচনায় হাম রোগের টিকা কার্যক্রম ঠিকভাব চলছে বলে দাবি করা হয়েছে। অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, হাম রোগের প্রাদুর্ভাব পর্যবেক্ষণের জন্য সার্বক্ষণিক নিবিড়, কার্যকর ও মানসম্পন্ন সার্ভিলেন্স পদ্ধতি এবং রেসপন্স ব্যবস্থা চালু আছে। প্রতি চার বছর অন্তর দেশে বিশেষ হাম ফলোআপ টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হয়। এটি সর্বশেষ ২০১৪ সালে হয়েছিল। পরের ফলোআপ টিকাদান হবে ২০১৮ সালের প্রথম।