বাংলাট্রিবিউন:
অতিবৃষ্টি, বন্যা, সংকট, সরবরাহে ঘাটতি, মজুদ কমে যাওয়া ও মিলারদের কারসাজিতে সারাদেশে চালের দাম কেজিতে বেড়েছিল ১০ টাকা। বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হলে সংকট নিরসনে আমদানিশুল্ক কমানো ও চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই মধ্যে চালের প্রথম দু’টি চালান বন্দরে এসে পৌঁছেছে। এতে পাইকারি বাজারে চালের দাম কেজিতে কমে মাত্র ৫০পয়সা থেকে ১টাকা। যা দেশের খুচরা বাজার পর্যন্ত পৌঁছায়নি। এরই মধ্যে চালের দাম আবার বেড়েছে। গিয়ে ঠেকেছে সেই আগের অবস্থানে। এখন সারাদেশে মোটা চাল প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৫০ টাকা দরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চালের মোকাম বলে খ্যাত কুষ্টিয়া, নওগাঁয় চালের দাম এবার বেড়েছে অতিবৃষ্টি ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির অজুহাতে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্যার যন্ত্রণা তো শেষ হয়নি। এর ওপর আবার সীমাহীন বৃষ্টি হচ্ছে। এতে রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে গেছে। আবার যেখানে পানি কমে গেছে, সেই রাস্তাঘাট নষ্ট, ভাঙাচোরো। এতে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। আগে নওগাঁ থেকে এক ট্রাক চাল ঢাকায় আনতে ভাড়া লাগতো ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা, সেখানে এই সময়ে ভাড়া গুনতে হচ্ছে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। পরিবহনের এই বাড়তি ব্যয় চালের ওপর পড়ছে। ফলে দাম বাড়ছে। এ ছাড়া এখন চাল পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় ট্রাকও ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ অনেক ট্রাক এখন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, এক খামার থেকে অন্য খামারে কোরবানির গরু পরিবহন করছে। কোরবানির আগে ট্রাক ব্যবসায়ীরা চাল পরিবহনের চেয়ে গরু পরিবহন করতে চায় বলে জানা গেছে। তাই চাল পরিবহনে ট্রাকভাড়া বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উত্তরবঙ্গ ট্রাক চালক সমিতির নেতা আবু তালেব বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ‘বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর রাস্তাঘাট খানাখন্দে পরিণত হয়েছে। ফলে ট্রাক গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় বেশি লাগছে। অন্যদিকে এই ভাঙা রাস্তায় গাড়ি চালাতে কষ্ট হয়, যে কারণে চালকরা যেতে চান না। আর ভাঙা রাস্তায় গাড়ি চালালে ট্রাকের ক্ষতি হয় বলে মালিকরাও গাড়ি দূরের রাস্তায় ছাড়তে চান না।’
জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার চাল ব্যবসায়ী আবু আজমল খান বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ‘পাইকারি বাজারে চালের দাম অনেকটাই কমেছে। কিন্তু খুচরা বাজারে কেন কমেনি, তা আমাদের জানার কথা নয়।’ তিনি জানান, ‘পাইকারি বাজারে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চালের দাম কমেছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা।’ তবে সম্প্রতি যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে চালের দাম আবার বাড়তে পারে বলে তিনি আভাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, বৃষ্টিতে চাতাল মালিকরা চাল শুকাতে পারছেন না। অনেকের গুদামে পানি উঠেছে। এতে অনেকটা চালই নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে দাম বৃদ্ধি পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
গত সপ্তাহে নাজিরশাল, মিনিকেট, বিআর আটাশসহ সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ২ থেকে তিন টাকা পর্যন্ত। রাজধানীর আড়তগুলোর অভিযোগ মিলারদের কারণেই কমছে না দাম। বজার ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর বাজারগুলোয় কিছু নতুন চাল এসেছে। পুরনো চালের সরবরাহও বেশ ভালো। বাজারে নাজিরশাইলের সর্বোচ্চ দর (প্যাকেট ছাড়া) ৫৮ টাকা, মিনিকেট ৫৮ টাকা, মোটা সেদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৫০ টাকা দরে। এই সময়ে বেড়েছে পাইজাম, আটাশ, বাসমতির দামও।
আড়তদাররা বলছেন, মিলারদের অস্বাভাবিক মজুদ প্রবণতার কারণে নিয়ন্ত্রণে আসছে না চালের বাজার। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, গত এক বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ। আর মাসিক মূল্যের ভিত্তিতে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বছর ভিত্তিতে টিসিবি দেখিয়েছে এক বছর আগে এ চালের কেজিপ্রতি দাম ছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। আর বাজারে বর্তমানে এ চালের দাম কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এক দশকে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি দ্বিগুণ। ১০ বছর আগে বাজারের সবচেয়ে কম দামি চাল ছিল বিআর ১১ ও বিআর ৮। ২০০৬ সালে প্রতিকেজি এ চাল বিক্রি হতো ১৮ থেকে ২০ টাকা দরে। যার দাম বর্তমানে ৪৮ টাকা। অর্থাৎ গত দশ বছরে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ২৫ থেকে ২৮ টাকা। মোটা চালের পাশাপাশি সরু ও মাঝারি দানার চালের দামও বেড়েছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তার এক বিশ্লেষণে বলেছে, গত এক দশকে পাঁচ ধরনের চালের বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সব ধরনের চালের দাম ১০ বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।
রাজধানীর কাওরানবাজারের চালের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সপ্তাহে দুই টাকা বাড়লেও চলতি সপ্তাহে সব ধরনের চালের দাম আবারও কেজিতে বেড়েছে এক টাকা। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি বাজারে গত সপ্তাহে যে দাম বেড়েছে, সেই বাড়তি দামের চাল বাজারে আসায় খুচরা পর্যায়ে দাম সামান্য বেড়েছে। নতুন করে পাইকারি বাজারে দাম বাড়েনি।
ঢাকার খুচরা বাজারগুলোয় মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৫৩-৫৫ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫২-৫৪ টাকা। নাজিরশাইল ৫৩-৫৮ টাকা, গত সপ্তাহে ছিল ৫২-৫৭ টাকা, পারিজাত প্রতি কেজি ৪৩ টাকা, গত সপ্তাহে ছিল ৪২ টাকা, গুটি স্বর্ণা ৪১ টাকা, গত সপ্তাহে ছিল ৪০ টাকা, ২৮ চাল ৪৭-৪৮ টাকা, আগে ছিল ৪৬-৪৭ টাকা কেজি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ‘আমদানিকৃত চালের চালান প্রায় প্রতিদিনই আসছে। আশা করছি চালের সংকট আগেও ছিল না। এখনও নেই। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মিলারদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছিল মাত্র। আমরা সেই অসাধু মিলারদের তালিকা তৈরি করে কালো তালিকাভুক্ত করেছি। সরকার সঠিক সময়ে চাল আমদানির ওপর শুল্কহার কমিয়ে ও চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে ওই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা গেছে।