শাহেদ মিজান, সিবিএন:
টানা বর্ষণে কক্সবাজারের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। অতি বর্ষণের ফলে পাহাড় ও নিন্মাঞ্চলে এখন মানুষের বসবাস দুর্বোধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড় ধসে কক্সবাজার শহর ও রামুতে দু’শিশুসহ চার জনের মৃত্যু। আহত আরো চারজন। অন্যদিকে গত চার দিনের ভারি বর্ষণে চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার অন্তত তিন লাখ মানুষ। ঢলের পানিতে বিভিন্ন সড়ক ও নানা ধরণের স্থাপনা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। আরো ভয়াবহ ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই সাথে পানি বাড়তে পানিবন্দি এলাকায়ও পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। এতে প্লাবিত এবং পাহাড়ি এলাকায় চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে প্রশাসনও পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক নজর রেখেছে। মঙ্গলবার কক্সবাজার শহরসহ বিভিন্ন স্থানের পাহাড়ি এলাকা থেকে অন্তত পাঁচ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারী মানুষকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। একই ভাবে পানিবন্দি এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ বেশি কিছু লোকজনকেও সরানো হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র মতে, কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁও এলাকায় প্রায় ১০০ মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। চকরিয়া-মগনামা সড়কের প্রায় ২ কিলোমিটার পানিতে তলিয়ে গেছে। চকরিয়া, রামু, পেকুয়া বিস্তীর্ণসহ জেলার সব নিচু এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। কক্সবাজার শহরের কয়েকটি নিচু এলাকাও পানিতে ডুবে গেছে। সব মিলে অন্তত তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কক্সবাজার শহরে পানিতে তলিয়ে গেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদরের ঈদগাঁও নদীর ওয়াপদার প্রায় ১০০ মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে পোকখালীর আবুল ফজল পাড়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে। ঈদগাঁও ফরাজী পাড়া, পোকখালী সড়কের পুর্বের নির্মিত বাঁশের সাকু পানির স্রোতে ভেসে গেছে। ইসলামাবাদের বাঁশ ঘাটার ঝুলন্ত ব্রীজটি যে কোন সময় ভেসে যেতে পারে। ঈদগাঁও ইউনিয়নের বাঁশখাইল্লা বিলের পুর্বের ভাঙ্গন থেকে পানি ঢুকে বৃহত্তর ভোমরিয়াঘোনা, কানিয়াছড়া, পালপাড়া, শিয়াপাড়া, দরগাহপাড়া প্লাবিত হয়ে তিন মাইজপাড়াসহ চান্দেরঘোনা, কালিরছড়া, ভাদিতলা পানিতে ভাসছে। সড়ক উপ-সড়ক ভেঙে মানুষ চলাচল করতে পারছে না।
অতিবৃষ্টিতে পানিতে ডুবে গেছে কক্সবাজার শহরের বিজিবি ক্যাম্প এলাকার সিকদার পাড়া, এসএমপাড়া, গোদারপাড়া, টেকপাড়া, পেশকারপাড়া ও পিটিস্কুল বাজার। মঙ্গলবার সারাদিন পিটিস্কুল বাজার পানিতে ডুবে থাকায় অধিকাংশ সময় যানচলাচল বন্ধ থাকে।
চকরিয়া উপজেলা ও পৌরসভার বেশির ভাগ নীচু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। মাতামুহুরী নদীতে ফের পাহাড়ি ঢলের পানি বেড়ে তা বিভিন্নভাবে ঢুকে পড়ে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকায় চকরিয়ায় আবারও বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্লাবিত হওয়ায় উপজেলার ও পৌরসভার নিমাঞ্চলে মানুষের পান্দিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকার কারনে মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে আবারও পাহাড়ি ঢলের পানি নামছে। কয়েকটি স্থান দিয়ে পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে। সব মিলে চকরিয়া উপজেলাজুড়ে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
পেকুয়ায় পাউবোর নিয়ন্ত্রনাধীন দুই পয়েন্টে বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে উজানটিয়া ইউনিয়নের পূর্ব উজানটিয়ার বিপুল এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানির আঘাতে উজানটিয়া ইউনিয়নের পূর্ব উজানটিয়া গোদারপাড়া স্টেশনের অদূরবর্তী স্থানে দুটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে।
উপজেলার ৯ টি ইউনিয়নে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। অব্যাহত বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলের পানিতে উপজেলার শিলখালী, বারবাকিয়া ও টইটং ইউনিয়নের বিপুল এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। পাহাড়ী ঢলের পানি উজানের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে মাতামুহুরী নদীসহ শাখা নদীগুলিতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে উপজেলার প্রধান সড়ক চকরিয়া-মগনামা সড়কের প্রায় ২ কিলোমিটার পানিতে তলিয়ে গেছে। চকরিয়া-পহরচান্দা সীমান্ত ব্রীজ থেকে শিলখালী ইউনিয়নের হাজিরঘোনা সালাহ উদ্দিন ব্রীজ পর্যন্ত সড়কটি পানিতে তলিয়ে যায়।
উজানটিয়া ইউনিয়নের বিপুল এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ বিলীন হওয়ায় এ ইউনিয়নের শত শত বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে। গ্রামীণ অবকাঠামো পানিতে তলিয়ে গেছে। গোদারপাড়ার সাথে সোনালী বাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রয়েছে। রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। চিংড়ি ঘের ও মৎস্যখামার পানির তোড়ে ভেসে গেছে। ফসল ও বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে।
রামু উপজেলায়ও নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ি ঢলে পানি বাঁকখালী নদীর বিপদ সীমা করে গত বন্যায় ভেঙে যাওয়া বাঁধের অংশ দিয়ে ঢুকে নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে রাজারকুল, ফতেখাঁরকুল, কাওয়ারখোপ ও দক্ষিণমিঠাছড়ি ইউনিয়নের সব নিচু এলাকা পানিতে ডুবে রয়েছে। পানিবন্দি রয়েছে লোকজন। নাইক্ষ্যংছড়ি-কচ্ছপিয়া-দুছড়ির প্রধান সীমান্ত সড়ক। অব্যাহত বর্ষণে সড়কটি সম্পূর্ণ নদীকে বিলীন হয়ে গেছে।
অবিরাম ভারি বর্ষণের কারণে কক্সবাজারে ভয়াবহ পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঝুঁকি জেনেও পাহাড়ে বসবাসকারী অন্তত ৩ লাখ মানুষ নিজ গৃহ ছেড়ে যাচ্ছে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিদিন মাইকিং করে সচেতনতা সৃষ্টিসহ ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলোয় অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করার পরও সরে আসেনি লোকজন। তাই প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে অনেককে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক জানান, গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার কারণে বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দর সমুহকে ৩নং স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এসব উপকুলীয় এলাকার মাছ ধরার ট্রলার ও নৌযানগুলোকে উপকুলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
২৪ ঘটনায় শুধুমাত্র কক্সবাজারে ২১৯মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আরো বৃষ্টিপাত হবে এবং ভয়াবহ পাহাড় ধসের আশংকা রয়েছে বলে জানান তিনি।
ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘টানা বর্ষণের কারণে জেলা অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল এখন পানিতে ডুবে গেছে। চারজনের মৃত্যুর ঘটনা সবাইকে উদ্বিগ্ন করেছে। সব বিষয়ে আমরা খোঁজ-খবর রাখছি। বিপদাপন্নদের সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।