ইমাম খাইর, সিবিএন:
‘হায় পাহাড়, তুই কেমনে আমার কলিজারে কেড়ে নিলি! আমার সাদ্দামরে ফিরাইয়া দে’-এমন বিলাপে বার বার মুর্ছা যাচ্ছিল শহরের কলাতলী লাইট হাউজপাড়ায় পাহাড় ধসে নিহত সাদ্দাম হোসেনের মা দিলদার বেগম। তার বুকফাটা আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে পুরো হাসপাতাল আঙ্গিনা।

পাহাড় কি শুনে সেই বিলাপ আর বুক ফাটা আর্তনাদ! এরপরও নিহত সাদ্দামের মায়ের ব্যর্থ আকুতি পুরো হাসপাতালের পরিবেশকে ভারি করে তুলে। এই কান্না দেখে সাধারণ রোগীদের স্বজনেরাও অশ্রু বিসর্জন দেয়। কিচ্ছ্ইু করার নেই। এটিই নিয়তি। এটিই প্রকৃতির খেলা।

সাদ্দাম হোসেন সদর উপজেলার দক্ষিণ পিএমখালী এলাকার এরশাদ উল্লাহর ছেলে। সে শহরের লাবণী পয়েন্ট সংলগ্ন হোটেল মিডিয়া ইন্টারন্যাশনালের ওয়ার্ড বয় হিসেবে কর্মরত ছিল।

শুধু সাদ্দাম নয়, তার আরেক ছেলে আরফাত উদ্দিন নয়নও পাহাড় ধসের ঘটনায় গুরুতর আহত হয়। তাকে হাসপাতালের ৫ম তলার সার্জারী ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে।সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে হাসপাতালে দেখা হয় নিহত সাদ্দাম হোসেনের ছোট ভাই মোতাহেরুল ইসলামের সঙ্গে। সে এক দৌঁড়ে আহত ভাই আরফাত উদ্দিন নয়নের খোঁজ নিতে হাসপাতালের পঞ্চম তলায় ওঠছে। আবার নীচে ট্রলিতে রাখা ভাইয়ের নিথর দেহের পাশে আসছে।

এ সময় হতাহতদের স্বজনেরাও হাসপাতাল আঙ্গিনায় ভিড় করে। সবার চোখে পানি আর বুক ভরা শোক। কেউ কাঁদছে আর কেউ কান্না চেপে লাশের পাশে বসে আছে। এমন দৃশ্য খুবই বেদনাদায়ক।

এমন সময় একটুখানি কথা হয় মোতাহেরুল ইসলামের সঙ্গে। সে জানায়, নিহত সাদ্দাম, আহত নয়নসহ তারা ৩ ভাই চাকুরী করে। দুই ভাই বাসা ভাড়া করে থাকে। ওই বাসায় ৫ জন থাকতো। ঘটনার রাতে ৪ জন বাসায় ছিল। অপরজন জিহান ছুটিতে বাড়ী গিয়েছিল।সোমবার (২৫ জুলাই) দিবাগত রাতে কক্সবাজার শহরের কলাতলী লাইট হাউজপাড়ায় পাহাড় ধসে নিহত হয়- সদর উপজেলার দক্ষিণ পিএমখালী এলাকার এরশাদ উল্লাহর ছেলে সাদ্দাম হোসেন (২৪) ও চৌফলদন্ডী খামারপাড়ার নুরুল হকের ছেলে মোহাম্মদ শাহেদ (১৮)।

গুরুতর আহত হয়েছে- নিহত সাদ্দাম হোসেনের ভাই আরফাত উদ্দিন নয়ন (১৭) উখিয়ার মরিচ্যা গোয়ালিয়া পালং এলাকার বশির উল্লাহর ছেলে দেলোয়ার হোসেন (১৭)।

আহতদের জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ওরা ৪ জনই হোটেল মিডিয়া ইন্টারন্যাশনালের কর্মচারী। লাইটহাউজপাড়ায় তারা ধসের শিকার বাসায় ভাড়ায় থাকতো। বাসাটির মালিক পিএমখালী এলাকার মহিউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি।

হতাহতদের স্বজনের ভিড় জেলা সদর হাসপাতালে।

হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাঃ মোঃ শাহিন আবদুর রহমান চৌধুরী জানান, পাহাড় ধসের ঘটনায় ৪ জনকে হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুইজন মারা যায়। অন্য দুইজনের চিকিৎসা চলছে। তারা আশংকামুক্ত।

সদর মডেল থানার ওসি রনজিত কুমার বড়ুয়া জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকর্মীদের সহায়তায় ৪ জনকে উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে মারা যাওয়া দুইজনের মরদেহ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন ওসি রনজিত কুমার বড়ুয়া।

স্থানীয় যুবক জামাল বলেন, রাত ২টার দিকে হঠাৎ পাহাড় ধ্বসে পড়ার বিকট শব্দ পেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখি পাশ্বের বাড়া বাড়িতে পাহাড় ধ্বসে মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে লোক। পাহাড় ধ্বসের খবর পেয়ে স্থানীয়রা দ্রুত উদ্ধার কাজ শুরু করেন। এর পরই উদ্ধারকাজে যোগ দেয় সদর থানার এক দল পুলিশ। স্থানীয়রা ঘণ্টাব্যাপী চেষ্টা চালিয়ে ৪ জনকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক শাহেদকে মৃত ঘোষনা করেন। পরে চিকিৎসারত অবস্থায় সাদ্দাম হোসেনও মারা যায়।

রামুর চেইন্দা কাইম্যারঘোনায় পাহাড় ধসে নিহত একই পরিবারের দুই শিশু।

এদিকে ঘটনার পরপরই খবর পেয়ে ছুটে যান বিএনপির কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল, জেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক কাজী মোস্তাক আহমদ শামীম ও ইমাম সমিতির জেলা সেক্রেটারী মাও. মুহাম্মদ আলমগীরসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার লোকজন।

মঙ্গলবার সকালে পাহাড়ের পাদদেশে যারা ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে তাদেরকে সরিয়ে যেতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে। যে জায়গায় পাহাড় ধ্বসে পড়েছে সেখানে আরো অন্ত্যত ২০/৩০ টি পরিবার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাদেরকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে রামুর চেইন্দা কাইম্যারঘোনা এলাকায় পাহাড়ধসে ঘুমন্ত অবস্থায় একই পরিবারের সায়মা (৫) ও জিহান (৭) নামের দুই শিশু মারা যায়। মাটিচাপা পড়া অবস্থায় তাদের বাবা জিয়াউর রহমান (৩৫) ও মা আনার কলিকে (২৯) জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। সায়মা-জিহানের ‘মা’ স্থানীয় মা ও শিশু হাসপাতালে এবং বাবা শহরের ফুয়াদ আল খতিব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের উপ-সহকারী পরিচালক অবদুুল মালেক বলেন, ভারি বর্ষণের ফলে রাত ৩ টার দিকে রামুর চেইন্দা এলাকায় পাহাড় ধসে ঘুমন্ত অবস্থায় একই পরিবারের চারজন মাটিচাপা পড়ে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ঘটনাস্থল পৌঁছে সায়মা ও জিহানের লাশ উদ্ধার করে। একই সঙ্গে মাটিচাপা পড়া অবস্থায় উদ্ধার হয় তাদের বাবা জিয়াউর রহমান ও মা আনার কলি।

আবদুল মালেক আরো বলেন, একই সময় কক্সবাজার শহরের লাইট হাউজ এলাকায় অপর একটি পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এতে মাটি চাপাপড়ে চারজন। স্থানীয়রা দ্রুত তাদেরকে উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর মোহাম্মদ শাহেদ ও সাদ্দাম হোসেন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। দেলোয়ার হোসেন ও আরফাত উদ্দিন নয়ন চিকিৎসাধীন রয়েছে।

প্রসঙ্গত, সোমবার দুপুর থেকে কক্সবাজারে থেমে থেমে ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। স্থানীয় আবহাওয়া অফিস জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৭৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আরো বৃষ্টিপাত হবে এবং পাহাড় ধসের আশংকা রয়েছে।

এছাড়াও উখিয়া, টেকনাফেও পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত আরও ছয়জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।