অনলাইন ডেস্ক :
মিয়ানমার থেকে আসা জীবন ধ্বংসকারী নিষিদ্ধ মাদক ইয়াবা পাচারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। বেনারকে এই তথ্য জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তির এই বিধান করার সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিদ্যমান আইনে মাদকদ্রব্য পরিবহনের সাজা ২ থেকে ১৫ বছরের জেল।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আইনি সংস্কারের পাশাপাশি ইয়াবা প্রবেশের মূল পথ টেকনাফে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি বিশেষ জোন স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া ইয়াবা পাচার বন্ধে দুই দেশের সীমান্ত নির্ধারণী নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ করা হবে।

ইয়াবা পাচারের সঙ্গে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা নাগরিক ও বাংলাদেশের এক শ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী জড়িত বলে জানিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “১৯৯০ সালে দেশে ইয়াবা ছিল না বললেই চলে। এ জন্য আইনে ইয়াবা পাচারের শাস্তির বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি। তবে বর্তমানে ইয়াবা পাচার মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে।”

“দেশের যুব সমাজকে রক্ষা করতে হলে ইয়াবা বন্ধ করতে হবে। ইয়াবা পাচারের শাস্তি বাড়াতে হবে এবং মাদকের মামলাগুলো তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করতে হবে,” তিনি বলেন।

সিউডোএফিড্রিন নামক রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে প্রস্তুত লাল রঙের ট্যাবলেট দেশের তরুণ-তরুণীদের একটি বিরাট অংশ যৌন উদ্দীপক হিসাবে ব্যবহার করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, এই ট্যাবলেট ব্যবহার করলে একজন মানুষ ঘুমাতে পারে না এবং দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারী একসময় পাগল হয়ে যায়।

“ইয়াবার ভয়াল ছোবলে দেশের যুব সমাজ আজ মারাত্মক পরিস্থিতির মুখোমুখি। এই ছোবল থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করতে আমরা ইয়াবার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছি। ইয়াবা পাচারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার জন্য আমরা ১৯৯০ সালের মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের সুপারিশ করেছি,” স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই সুপারিশ মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেলে আইনটি সংশোধনের জন্য আইন সভায় উত্থাপিত হবে বলে জানান মন্ত্রী।

গত দুই মাসে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কয়েক লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন টেকনাফ বিজিবি কমান্ডার ও পরিচালক এস এম আরিফুল ইসলাম।

গত ২৮ জুন সংসদে দেওয়া এক লিখিত বিবৃতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ইয়াবার অন্যতম কাঁচামাল সিউডোএফিড্রিন আমদানি এবং সিউডোএফিড্রিন দিয়ে প্রস্তুত যে কোনো ধরনের ওষুধ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ইয়াবা প্রবেশ দ্বার টেকনাফে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি বিশেষ জোন স্থাপনের জন্য গত ৫ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বরাবর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।”

কক্সবাজার, উখিয়া ও টেকনাফে মাদক ব্যবসায়ীদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ২০১১ সালের ১৫-১৬ নভেম্বর মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে এবং ২০১৫ সালের ৫-৬ মে তারিখে ঢাকায় উভয় দেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মহাপরিচালক পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ইয়াবা বন্ধে মতৈক্য হয়।

এ ছাড়া গত সপ্তাহে চট্টগ্রামে মাদকদ্রব্য ধ্বংস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ইয়াবা চোরাচালান বন্ধ করতে নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ করতে পারে সরকার।”

তবে তিনি মাছ ধরা বন্ধের কোনো তারিখ ঘোষণা করেননি।

ইয়াবার বিস্তার চলছে

প্রতি বছর দেশে কী পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেট মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে আসে তার কোনো সঠিক তথ্য নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালে আট লাখের কিছু বেশি সংখ্যক ইয়াবা পাচারের সময় ধরা পড়ে।

২০১৫ সালে ধরা পড়ে দুই কোটির বেশি পিস ইয়াবা। আর ২০১৬ সালে প্রায় তিন কোটি ইয়াবা পাচারের সময় ধরা পড়ে। তবে ২০১৭ সালে ইয়াবা পাচারের প্রকোপ বেড়েছে বলে বেনারকে জানান টেকনাফের বিজিবি পরিচালক কর্নেল আরিফুল ইসলাম।

“মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে আসা ইয়াবার প্রকৃত পরিমাণ ধরা পড়া পরিমাণের চেয়ে কয়েক গুন। রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ইয়াবা পাচার করে। নাফ নদীতে মাছ ধরা জেলেদের একটি অংশ ইয়াবা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে,” বলেন তিনি।

কর্নেল আরিফের মতে, ইয়াবা চোরাচালান ছাড়া বর্তমানে রোহিঙ্গাদের কোনো কাজের সুযোগ নেই।

তবে রোহিঙ্গারা বেঁচে থাকার জন্যই এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয় বলে মনে করেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর।

তিনি বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা প্রকৃতপক্ষেই অসহায়। তাঁরা মিয়ানমারে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আসে। এখানেও তাঁদের কোনো অধিকার নেই। সুতরাং, তাঁদের একটি অংশ ইয়াবা পাচারসহ কিছু অপরাদের সঙ্গে জড়িত থাকতেই পারে।”

উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থী হাকিম বেনারকে বলেন, “কেবল রোহিঙ্গা নয় ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে বাঙালি, আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু লোকও জড়িত। কিন্তু দোষ হয় শুধু রোহিঙ্গাদের। একা রোহিঙ্গাদের পক্ষে কি ইয়াবা ব্যবসা করা সম্ভব?”

সর্বশেষ জুলাই ১১ তারিখে টেকনাফ বিজিবি তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা মূল্যের এক লাখ দশ হাজার পিস ইয়াবাসহ দুই রোহিঙ্গা পুরুষকে আটক করে।

ঢাকার শেওড়াপাড়ার এক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে কথা হয় ব্যবসায়ী মশিউর রহমানের (ছদ্মনাম) সাথে। তার ২২ বছর বয়স্ক একমাত্র ছেলে ইয়াবায় আসক্ত।

“বন্ধুদের সঙ্গে ইয়াবা কেমন সেটা জানতে ইয়াবা সেবন করে আসক্ত হয়ে পড়ে সে। আমি জানি না আদৌ সে আর সুস্থ হয় উঠবে কিনা,” আক্ষেপ করে বেনারকে বলেন বাবা রহমান।

“সরকার কেন ইয়াবা ব্যবসায়ীদের প্রতি কঠোর হচ্ছে না। ইয়াবা যুব সমাজ ধ্বংস করে দিচ্ছে,” তিনি বলেন।