শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার :
কক্সবাজার শহরের কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনের পূর্ব পাশে সেই আলোচিত ৫১ একর খ্যাত ‘সরকারী আবাসন প্রকল্পে’র নামে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে কোন আলামতই দেখা যাচ্ছে না। সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই প্লট আকারে সরকারী জমি বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। গত দু’মাসেই অন্তত দেড় শতাধিক ‘প্লট’ দখল বিক্রি ও হস্তান্তর করা হয়েছে। বিক্রিত প্লটের জমিতে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। আর এসব স্থাপনা মাসিক ভাড়াও দেয়া হচ্ছে। ভাড়া বাসায় অবস্থান করে অনেকে মাদক ব্যবসা সহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধীদের নিরাপদ অস্তানা হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে আলোচিত ৫১ একরে গড়ে উঠা বেশির ভাগ অবৈধ স্থাপনা।
গত ২০ মার্চ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন প্রকল্পের জন্য দেয়া ৫১ একরের প্লট বরাদ্দ অবৈধ ঘোষণা করেন আপিল বিভাগও। নির্দেশনা দিয়েছেন সেখানে দখলে থাকাদের উচ্ছেদের। শহরের কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনের পূর্ব পাশে পাহাড়ের ওই জমি বরাদ্দ দিয়েছিল জেলা প্রশাসন।
এদিকে, সেই ৫১ একরের দখল উচ্ছেদের রায় দেয়ার পরপরই প্লট প্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মোটা অংকের টাকা প্লট বিক্রি করে যাচ্ছেন।
সবশেষ গত ৩০ এপ্রিল ৪ কাটা প্লট চারজন কর্মচারী বিক্রি করেছেন ২৪ লাখ টাকায়। চকরিয়া উপজেলার ফাসিয়াখালী ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড দক্ষিণ সিকদারপাড়া গ্রামের মরহুম ফজল আহম্মদের ছেলে সৌদি প্রবাসী নুর মোহাম্মদ ও তার স্ত্রী মাহাফুজা আকতার জমিটি কিনে সেখানে স্থাপনা নির্মান করে বাসা ভাড়া দিয়ে যাচ্ছে। এধরনে সৌদি প্রবাসী নয় শুধু গত দুই মাসে অন্তত দেড় শতাধিক প্লট (কাটা হিসেবে) বেচা বিক্রি হয়ে গেছে।
নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে সরকারী জমি বিক্রি রশিদ দিয়েছে টেকনাফ নতুন পল্লানপাড়ার আবুল মনজুরের ছেলে মোস্তফা আহমদ, রামু চাইন্দা খোন্দকারপাড়া মৃত জহুর আলমের ছেলে মোঃ ফরিদুল আলম, রামু ফতেখারকুল মধ্যম মেরুংলোয়া সিরাজ উদ্দিনের বাড়ী মৃতগুরামিয়ার ছেলে নুর হোছাইন ও কক্সবাজার পৌরসভাধীন উত্তর বাহারছড়ার ছিদ্দিক আহম্মদের ছেলে জালাল আহম্মদ। এরা সবাই সরকারী কর্মচারী এবং ওই আবাসন প্রকল্পের সদস্য। নোটারী পাবলিক কার্যালয় কক্সবাজারে ছাফ বিক্রির রসিদপত্র মুলে ২৪ লাখ টাকায় ৪ কাটা ভিটে জমি বিক্রির প্রথম কিস্তির ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা গ্রহণ করে দখল বুঝিয়ে দেয়া হয়।
আর ওই রশিদে প্রধান স্বাক্ষী হিসেবে আছেন সরকারী আবাসন প্রকল্পের অধীনে প্লট বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ, সরকারী আবাসন প্রকল্প সদস্য সলিম উল্লাহ, রেকাতুল করিম মানিক সহ আরো কয়েকজন।
সচেতন মহলের প্রশ্ন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের জন্য ২০০৬ সালে নির্বিচারে পাহাড় কেটে ও বড় বড় বৃক্ষ ধবংস করে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। এখন উচ্ছেদের নির্দেশ আসায় সরকারী জমি প্লট আকারে বিক্রি করে যাচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সুত্রে জানা গেছে, গত ২০ মার্চ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন প্রকল্পের জন্য দেয়া ৫১ একরের প্লট বরাদ্দ অবৈধ ঘোষণা করেছেন আপিল বিভাগও। নির্দেশনা দিয়েছেন সেখানে দখলে থাকাদের উচ্ছেদের।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নের্তৃত্বে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ জেলা প্রশাসকের সিভিল রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দেন এবং বহাল রাখেন হাইকোর্টের আদেশ। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আইনজীবী কবির সায়ীদ বলেন, এর ফলে ওই সরকারী আবাসন প্রকল্পটি অবৈধ হয়ে যায়।
কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনের পূর্ব পাশে পাহাড়ের মৌজা-ঝিলংজা,কক্সবাজার পৌরসভার জেএলনং-১৭,কক্সবাজার মহাল নয়াবাদ ৩৪৬১৩ নং তৌজিভুক্ত। সরকারের পক্ষে সহকারী কমিশনার ভুমি (সদর) কক্সবাজারের অধীনে দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্তী মামলা নং-০৩/২০০৬ইং জেলা প্রশাসক কক্সবাজার সরকারী কর্মচারী সমিতির নামে ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারী সরকারী আবাসন প্রকল্পের সদস্যদের নামে বিএস ১ নং খতিয়ানের বিএস ২০১৬৩ দাগের আনন্দর সাবেক জঙ্গল শ্রেণী জমি, বর্তমানে ভিটে শ্রেণীর জমি রশিদ মুলে প্রতি কাটা ২ লাখ হারে আদায় করে প্লট বরাদ্দ দিয়েছিল জেলা প্রশাসন।
অবশ্য ঝিলংজা মৌজার আরএস ৮০০১ নম্বর দাগের ১২৪ একর রক্ষিত বন ও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা থেকে ৫১ একর বনভূমি জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলতে বরাদ্দ দেয় জেলা প্রশাসন। ওই বরাদ্দ বাতিল, পাহাড় ও বনজ সম্পদ ধ্বংসের বিরুদ্ধে বেলা ২০০৬ সালে হাইকোর্টে রিট করে। হাইকোর্ট ২০১১ সালের ৮ জুন বরাদ্দ বাতিল, পাহাড়ের কোনো অংশ না কাটা, রক্ষিত বন এলাকায় সব ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদ করা এবং বন ধ্বংস না করতে আদেশ দিয়ে রায় দেন। রায় বাস্তবায়ন না করায় ১২ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বেলা আদালত অবমাননার মামলা করে। পরে আদালত কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে হাইকোর্টে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির হয়ে আদেশ বাস্তবায়নের জন্য সময় চান তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোঃ রুহুল আমিন। আদালত সময় মঞ্জুর করে তিন মাসের মধ্যে সব স্থাপনা উচ্ছেদ করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে অঙ্গীকারনামা নেন তার কাছ থেকে। কিন্তু তিন বছর চলে গেলেও সে আদেশ বাস্তবায়ন করেনি জেলা প্রশাসন। বরং ওই জমিতে পাহাড় ও গাছ কেটে স্থাপনা নির্মাণ কাজ অব্যাহত থাকে।
সরকারী আবাসন প্রকল্পের অধীনে প্লট বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ বলেন, যারা বিক্রি করছে তারা সবাই সরকারী প্লট হোল্ডার। টাকা দিয়ে প্লট বরাদ্দ নিয়েছে এবং টাকার প্রয়োজন হওয়ায় এরা বিক্রি করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, বরাদ্দ পাওয়া প্লটগুলো বিক্রিতে কোন বাধা নেই। প্লট মালিকরা সরকারকে রাজস্ব দিয়ে প্লট বরাদ্দ নিয়েছে, তাই যে সদস্য বিক্রি করতে পারবে। টাকার প্রয়োজনে এধরনে আরো অনেক প্লট হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
সরকারী জমি বিক্রির কোন নিয়ম আছে কিনা সে বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একান্ন একর জমির বিষয়ে আমি জড়িত নেই, সে বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।