বাংলাট্রিবিউন:
আগস্ট মাসে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট চূড়ান্ত হওয়ার পর সাইবার অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে চলমান মামলাগুলোর ভবিষ্যত কী হবে, সে প্রশ্নের কোনও উত্তর পাচ্ছেন না মামলার ভুক্তভোগীরা। ‘যতক্ষণ ৫৭ ধারা আছে, ততক্ষণ মামলা হবে’, আইনমন্ত্রীর এমন বক্তব্য এই ধারার মামলাগুলোর পরিণতিকে আরও অস্পষ্ট করে তুলেছে। এদিকে, পাবলিক প্রসিকিউটর বলছেন, কেবল চার্জশিট হওয়া মামলাগুলোই এই আইনে চলবে, বাকি মামলাগুলো ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রণয়নের পর সেটির যথাযথ ধারায় সন্নিবেশিত হবে। আর আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, আইন রহিত হওয়ার আগ পর্যন্ত দায়ের করা সব মামলা শেষ পর্যন্ত ওই আইনের ধারাতেই অব্যাহত থাকবে। ৫৭ ধারা বাতিল হওয়ার পর মামলাগুলোর কী হবে, এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে।
সাইবার সিকিউরিটি ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরের দেওয়া তথ্য মতে, সারাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের হওয়া ৭শ ৪০টি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে ৬০ শতাংশ মামলা রয়েছে ৫৭ ধারার। ২০১৩ সালে প্রথম ৩টি মামলা হওয়ার পর প্রতি বছর মামলার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৪ সালে সারাদেশে ৩৩টি মামলা হলেও ২০১৫ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫২। ২০১৬ সালে মামলার সংখ্যা ২শ’ ৩৩টি, আর এবছর জুলাই পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৩শ’ ১৯টি। আইন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়েরের সংখ্যা বেড়েছে। শঙ্কার বিষয় হলো, হয়রানি করার লক্ষ্যে আইনটির অপব্যবহারও হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ৪৪ ধারায় আইসিটি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল করতে বলা হয়েছে। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (খসড়া) ১৯ ধারায় আরও সুনির্দিষ্টভাবে ৫৭ ধারার বিষয়বস্তুই সন্নিবেশিত হচ্ছে। নতুন আইনে অপরাধের সাজা কমানোর প্রস্তাব আছে এবং একই সঙ্গে একেক অপরাধে সাজার পরিমাণ একইরকম করার কথা বলা হয়েছে।
আইসিটি আইনে ৫৭ ধারার অপরাধের জন্য অনধিক ১৪ বছর ও অন্যূন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান থাকলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় ১৯ ধারার অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছর ও সর্বনিম্ন দুই মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
৫৭ ধারা থাকবে না, থাকছে না বলে আইনমন্ত্রীর বছরব্যাপী আশ্বাসের মধ্যে, এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই এই ধারায় দেশের বিভিন্ন জেলায় মামলা হয়েছে ২০টির বেশি। সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহল এই ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও একাধিকবার বলেছেন, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা থাকবে না। নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। ওই আইনে ৫৭ ধারার বিষয়টি পরিষ্কার করা হবে।
৫৭ ধারার মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেসব মামলায় চার্জশিট হয়ে গেছে সেগুলোর বিচার এই আইনেই হবে। যেগুলোর চার্জশিট হয়নি সেগুলোর বিচার ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের বিভিন্ন যথাযথ ধারায় নিয়ে পরিচালনা করা হবে।’ তিনি জানান, মোট মামলার মধ্যে চারশ’ মামলার চার্জশিট ইতোমধ্যে হয়ে গেছে, যেগুলোর বিচার শুরু হয়ে গেছে।
৫৭ ধারায় বিচারের মুখোমুখি হওয়া সাংবাদিক প্রবীর শিকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৫৭ ধারা থাকলো নাকি সেটা নতুন আইনের ১৯ ধারায় গেল, সেটা এখন বিবেচ্য বিষয় না। আমার কথা হলো, নাগরিকের মতামত প্রকাশ করার ওপর হস্তক্ষেপ চলবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই আইন হয়রানিমূলকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, এর প্রমাণ ইতোমধ্যে মিলেছে।’ এই ধারা রহিত হলে চার্জশিট না হওয়া মামলাগুলোর কী হবে, তা সরকারই নির্ধারণ করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে উচ্চ আদালতের আইনজীবী মোহম্মদ আসাদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকার সুনির্দিষ্ট কোনও নির্দেশনা না দিলে অপরাধ সংঘটনের দিন যদি তথ্যপ্রযুক্তি আইন বলবৎ থাকে, তাহলে বিচার সেই আইনেই হবে। পরবর্তীতে আইন হলে তখন থেকে সেই অপরাধগুলো ওই আইনের অধীনে মামলার মুখোমুখি হবে। এখানে মামলা হয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো নতুন আইনে ফেলার কোনও সুযোগ নেই।’
৫৭ ধারা বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে যেন একই ধরনের পীড়নমূলক পদ্ধতি নিয়ে হাজির না হয়, সেই দাবি থাকার পরও নতুন আইনে তা আমলে নেওয়া হলো না উল্লেখ করে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেদিন আইনটি (আইসিটি) বাতিল হবে সেদিন থেকেই এই ধারায় আর মামলা হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেগুলো চার্জশিট হয়েছে সেগুলোর বিচারকাজ আগের মতোই চলবে। যেগুলো তদন্ত হচ্ছে সেগুলোর কার্যক্রমও একইভাবে অব্যাহত থাকবে। যদি নতুন আইনকে পুরনো অপরাধের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তাহলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।’ এর জন্য সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনার বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৫৭ ধারা যতদিন থাকবে এই ধারায় মামলা হবে। পরবর্তীতে আইন কী হচ্ছে, সেটা হওয়ার পর বলা যাবে। ৫৭ ধারায় বর্তমানের মামলাগুলোর কী হবে, তা তখনই দেখতে পাবেন। যদি এমন কিছু হয় তখন নিশ্চয়ই কোনও নির্দেশনা থাকবে। তবে বর্তমান মামলাগুলো এই ধারাতেই শেষ হবে। নিয়মানুযায়ী নতুন আইনে নতুন মামলা হবে। এ নিয়ে কোনও বিশৃঙ্খলার সুযোগ নেই।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।