বাংলাট্রিবিউন:

চিকুনগুনিয়া বাহিত এডিস মশারাজধানী ঢাকায় তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে চলছে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ। এটি এখন এক আতঙ্কের নাম। ঘরে-ঘরে এক বা একাধিক সদস্য মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত বলে খবর পাওয়া গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রাজধানীতে জ্বরে আক্রান্ত প্রতি তিন জনের একজন এই রোগে আক্রান্ত। এখন ঢাকায় এমন কোনও পরিবার পাওয়া যাবে না, যেখানে চিকুনগুনিয়ার রোগী নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে বলা হচ্ছে, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর প্রাদুর্ভাব থাকবে রাজধানীতে। জনগণ সচেতন না হলে আগামীতে পুরো দেশেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশেই চিকুনগুনিয়াতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সিটি করপোরেশনের পদক্ষেপ নিতে দেরি করায় আজ এ অবস্থা বলেও তারা মন্তব্য করেন।

গত বছরের ডিসেম্বর মাসে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হন রামপুরার বাসিন্দা ফাইজা রহমান। প্রায় ৭ মাস পর সোমবার (১০ জুলাই) ফাইজা বলেন, ‘কোনও জ্বরের ইফেক্ট যে এতদিন থাকতে পারে, তা চিকুনগুনিয়া না হলে বুঝতাম না। জ্বর সেরেছে কিন্তু এখনও ভুগছি। পায়ের র‌্যাশ হয়ে গিয়েছে, জয়েন্টের ব্যথা এখনও আছে, মাঝেমাঝেই সে ব্যথা বেড়ে যায়। এখনও পা ভাঁজ করে বসতে পারি না।’ আর রবিবার (৯ জুলাই) থেকে ফাইজার স্বামী অনিন্দ রহমানও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে তিনি জানান।

এদিকে, কাঁঠালবাগান এলাকার বাসিন্দা ৬৭ বছরের মিনহাজ মাহমুদ প্রথম আক্রান্ত হন এই জ্বরে, সপ্তাহ না গড়াতেই তার স্ত্রী রাবেয়া সুলতানা ও প্রায় একইসঙ্গে তাদের বড় ছেলে, ছেলে বউ ও তার সন্তান আক্রান্ত হন চিকুনগুনিয়ায়। এই পরিবারের ছোট ছেলে অদিতি মাহমুদ বলেন, ‘আমরা দুই ভাই কেবল এখন বাকি আছি।’

মিরপুর ১০-এর বাসিন্দা হোসনে আরা বেগম বিনু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাড়ের ব্যথায় এমন অবস্থা যে, এখনও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি না, নিচু করে কিছু তুলতে পারি না, ব্যথায় বাঁকা হয়ে যেতে হয়।’

গত ১৮ মে রাজধানীর কাঁঠালবাগান কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, গ্রিনরোড ও রামপুরা এলাকায় চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ বেশি বলে জানালেও পরে গত ৮ জুন গুলশান-১, বনানী, লালমাটিয়া, পল্লবী, মধ্যবাড্ডা, উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর, মগবাজার, মালিবাগ চৌধুরী পাড়া, রামপুরা, তেজগাঁও, নয়াটোলা, কুড়িল, পীরেরবেগ, রায়েরবাজার, শ্যামলী, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর, মণিপুরিপাড়া, মোহাম্মদপুর, মহাখালীম মিরপুর-১ ও কড়াইলবস্তিকে চিকুনগুনিয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে ঘোষণা করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। এরপর পুরো ঢাকায় এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। ।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকুনগুনিয়ার রোগীর ভিড় বেড়েছে। তবে গত বছরের শেষ থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ঠিক কত রোগী চিকুগুনিয়াতে আক্রান্ত হয়েছে তার সঠিক কোনও হিসাব নেই।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর মোবাইল ফোনভিত্তিক এক জরিপ থেকে সম্ভাব্য ৪ হাজার ৭৭৫ জন রোগীর মধ্যে থেকে তারা ৩৫৭ জনের চিকুনগুনিয়া নিশ্চিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইনস্টিউটের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা।

প্রতিষ্ঠানটি গত তিন মাসে ৬৪৩ জন ব্যক্তির লালা ও রক্তের নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে ৫১৩ জন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত বলে জানায়। আইইডিসিআরের নমুনা পরীক্ষায় শতকরা ৮০ জনই চিকুনগুনিয়াতে আক্রান্ত বলে জানা গেছে। সংস্থাটি বলছে, চলতি বছরে কেবল রাজধানীতে থাকলেও সচেতন না হলে ভবিষ্যতে হয়তো পুরোদেশেই সেটি ছড়িয়ে পরতে পারে।

চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই বলে বলেই চলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন। তাদের এ বক্তব্যকে ‘হতাশাজনক’ বলে জানিয়েছেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সম্পাদক সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সিটি করপোরেশনের উদাসীনতাই চিকুনগুনিয়ার প্রার্দুভাবের জন্য বেশি দায়ী।’ অথচ আইইডিসিআরের নমুনা পরীক্ষাই চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব প্রমাণ করে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যালে ২১ মে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, ‘চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, সচেতনতাই পারে এই রোগের প্রকোপ কমাতে।’ এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিকুনগুনিয়া নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। এ রোগের প্রাদুর্ভাব হওয়ার আশঙ্কা নেই। সরকার সবসময়ের মতো চিকুনগুনিয়া নিয়েও সতর্ক।’

‘চিকুনগুনিয়া দেশব্যাপী ছড়িয়েছে’ বলে মন্তব্য করে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক সোমবার জানিয়েছেন, ‘মশা নিধনের কাজ সিটি করপোরেশনের, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়।’

সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের প্রতিটি জেলায় হেল্প ডেস্ক খোলার নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। মন্ত্রীর নির্দেশে দেশের সব জেলায় হেল্প ডেস্ক খোলা হচ্ছে। একইসঙ্গে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীদের শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধির ব্যথা প্রশমনে প্রতিটি হাসপাতালে প্রয়োজনে জয়েন্ট পেইন ক্লিনিক বা আর্থালজিয়া ক্লিনিক খোলারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কী করা হচ্ছে—জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক (সিডিসি) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা বলেন, ‘সারাদেশে চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য পাবলিক হেল্থ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ফর চিকুনগুনিয়া (চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণ কক্ষ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।’

তবে ইতোমধ্যেই চিকুনগুনিয়া ঢাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। লালমনিরহাট, ময়মনসিংহ ও ঠাকুরগাঁয়ে চিকুনগুনিয়ার রোগী পাওয়া গেছে জানিয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক বলেন, ‘ধারণা করছি, এসব রোগী ঢাকা থেকে যাওয়ার পর রোগটি হয়েছে। তারা আক্রান্ত হয়েছেন ঢাকায়।’

চিকুনগুনিয়া প্রিভেন্টেবল ডিজিজ জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক এম মুজাহেরুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা তো এমন না যে, প্রিভেন্ট করা যাবে না। এটা মশাবাহিত অসুখ। কিন্তু মশা নিধনের জন্য যা যা করা উচিত ছিল, সেটা করা হয়নি।’

আইইডিসিআর-এর মোবাইল জরিপের সম্ভাব্য রোগীর সংখ্যা সত্য ধরে নিয়ে কাজ করলেও সেটা বিরাট সংখ্যা জানিয়ে অধ্যাপক মুজাহেরুল হক বলেন, ‘কেবল বাংলাদেশ নয়, পাশের দেশ ভারত, নেপাল, মিয়ানমারেও বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে। সেসব দেশে চিকুনগুনিয়া নেই। চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। এর আগে এত আক্রান্ত রোগী বাংলাদেশে কখনও দেখা যায়নি।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) মাইক্রোবায়োলজি ও মাইকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, ‘চিকুনগুনিয়া কোথায় নেই? কোনও অসুখ নিয়ে এমন আলোচনা ও মানুষের ভোগান্তি বাংলাদেশে আর হয়নি। বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়ার রোগী যত রয়েছে, অন্যান্য দেশে তত রয়েছে কিনা, সেটা দেখার বিষয়।’

উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে ভারতে চিকুনগুনিয়া ভয়াবহ রূপ নিলে আইইডিসিআর বাংলাদেশে জরিপ চালায়। তখন এ রোগে আক্রান্ত কোনও বাংলাদেশি পাওয়া যায়নি। পরে ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া গিয়েছিল।