শাহেদ মিজান, সিবিএন:
প্রবল বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যা কক্সবাজারের চার উপজেলায় ভয়াবহ আকারে আঘাত করেছে। বন্যা ও পাহাড় ধসে ৮ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটেছে। একই সাথে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যা আক্রান্ত এলাকাগুলো এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টি কমায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখনো পানি নেমে যায়নি। এ কারণে এখনো পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। এসব মানুষ খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে পড়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হলেও তা খুবই অপ্রতুল। বন্যা আক্রান্তদের মাঝে হাহাকার বিরাজ করছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, প্রবল বৃষ্টিতে জেলার চকরিয়া, রামু, কক্সবাজার সদর, উখিয়া, পেকুয়া উপজেলা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে চকরিয়া ও রামু অবস্থা অত্যন্ত মারাত্মক। এই দু’উপজেলার সব ইউনিয়ন বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার সদরের পাঁচটি ইউনিয়ন ও উখিয়ার তিনটি ইউনিয়ন মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে। এতে এই চার উপজেলায় প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পেকুয়ার কিছু এলাকাও আক্রান্ত হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টানা প্রবল বর্ষণের কারণে মাতামুহুরীর নদীর পানি উপচে চকরিয়া উপজেলার পৌসভার ৯নং ওয়ার্ড এবং সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, হারবাং, কোনখালী, ঢেমুশিয়া, খুটাখালী, ডুলাহাজারা, সাহারবিল পুরোসহ ১৭ ইউনিয়ন বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এতে প্রায় অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। বৃষ্টি কমে আসায় বৃহস্পতিবার থেকে অন্যসব সব ইউনিয়ন থেকে পানি নেমে গেলেও উপকূলীয় সাত ইউনিয়নে এখনো পানি কমেনি। পানি না কমায় উপকূলীয় ইউনিয়ন পূর্ববড় ভেওলা, বদরখালী, পশ্চিম বড়ভেওলা, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, ভেওলা মানিকচর ও বমুবিলছড়িতে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে এসব ইউনিয়নের সব লোকজন পানিবন্দি হয়ে আছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে এসব লোকজন খাবার ও পানির তীব্র সংকটে ভুগছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরবরাহ ত্রাণ তাদের প্রয়োজনের সিকি পরিমাণও হয়নি।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘বৃষ্টি কমলেও এখনো মাতামহুরী নদী অঞ্চলের উপকূলীয় সাত ইউনিয়নের এখন পর্যন্ত পানি কমেনি। অন্যসব ইউনিয়ন থেকে পানি নেমে যাচ্ছে।’
তিনি জানান, চকরিয়ার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, ১০০০ প্যাকেট শুকনো খাবার ও পাঁচ মেট্টিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চালগুলো বিতরণ করা হচ্ছে। টাকা দিয়ে চিড়া ও চিনি কিনে বন্যা আক্রান্ত মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে।
অতি বৃষ্টিতে বাঁকখালীন নদীর পানিতে ডুবে গিয়ে রামুর সব ইউনিয়নই বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। তার মধ্যে গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখোপ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়াও জোয়ারিয়ানালা, দক্ষিণমিঠাছড়ি, রাজারকুল ও ফতেখাঁরকুলে ইউনিয়নও বন্যা চরমভাবে আক্রান্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার অন্যনা ইউনিয়ন থেকে পানি কিছুটা নেমে গেলেও গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এসব ইউনিয়নের সব লোকজন পানিবন্দি হয়ে রয়েছে। অন্যদিকে বন্যার পানিতে ডুবে বৃহস্পতিবার উপজেলার উত্তর ফতেখাঁরকুল চালইন্নাপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এতে নিহতরা হলো ওই এলাকার কামাল হোছনের ছেলে মোঃ শাহিন (১০) ও মোঃ ফাহিম (৮) নামে দু’শিশু নিহত হয়েছে। বন্যার রামুতে রাস্তাঘাট, বসতঘর, বীজতলাসহ ফসল ও বিভিন্ন স্থাপনার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহজাহান আলী বলেন, রামু সব ইউনিয়ন বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া ও কাউয়ারখোপ মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত হয়েছে। বৃষ্টি কমাতে পানি নেমে যাচ্ছে। তবে উপরের পানি এখন নিচু ইউনিয়ন গুলোতে জমা হচ্ছে। বন্যার পানিতে দু’শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
তিনি জানান, বন্যা আক্রান্ত জন্য জেলা প্রশাসন থেকে তিন’শ প্যাকেট শুকনো খাবার ও দু’মেট্টিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এগুলো বিতরণ করা হয়েছে। আরো বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। আপাতা চেয়ারম্যানদের ফান্ড থেকে সহযোগিতা দিতে বলা হচ্ছে। এছাড়া নিহত দু’শিশুর পরিবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে অনুদান দেয়া হয়েছে।
প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় পুরো উখিয়ার উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছে। তার মধ্যে রত্মপালং, হলদিয়া পালং ও জালিয়াপালং মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া ও পাহাড় ধসে উখিয়ায় চার জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন, জালিয়া পালং ইউনিয়নের সোনাই ছড়ি এলাকার জাফর আলমের মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা দাখিল মাদ্রাসার ৭ম শ্রেণির ছাত্রী ছামিরা আক্তার (১৪) ও রতœাপালং ইউনিয়নের মধ্যরতœা এলাকার অমূল্য বড়–য়ার ছেলে পালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্র ইতন বড়–য়া (১৪)। পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমানপাড়া এলাকায় পাহাড় ধসে পড়ে শাহারিয়ার বাপ্পি নামের এক শিশু মারা গেছে। রতœাপালং ইউনিয়নের সাদৃকাটা নামক এলাকায় বন্যার পানি দেখে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মোঃ ইসলাম সাওদাগর (৫৫) নামে এক জনের মৃত্যু হয়। বৃহস্পতিবারও উপজেলার অধিকাংশ এলাকার নিন্মাঞ্চল পানিবন্দী হয়ে রয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে রয়েছে লক্ষাধিক মানুষ। এলাকার মৎস্যঘের, পানের বরজ, ক্ষেত-খামারসহ গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত উপজেলার কোথাও সরকারি পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ হয়নি।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাঈন উদ্দীন বলেন, উখিয়া প্রায় সব উপজেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে রত্মাপালং, হলদিয়া পালং ও জালিয়াপালং ইউনিয়ন মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে। বন্যায় পানিতে ভেসে গিয়ে দু’জন, পাহাড় ধসে একজনসহ চারজন মারা গেছে।
তিনি জানান, উখিয়ার এখনো পর্যন্ত (বৃহস্পতিবার) সরকারি ভাবে ত্রাণ বরাদ্দ হয়নি। বরাদ্দের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ৪০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ হয়েছে। ত্রাণ সহায়তাও বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। শুক্রবার বরাদ্দ পাবো বলে আশা করছি। পেলে বন্যা আক্রান্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও, চৌফলদন্ডী, ঝিলংজা, জালালাবাদ, পোকখালী বন্যায় মারাত্মকবাবে আক্রান্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অধিকাংশ এলাকা পানিবন্দি রয়েছে। এতে লোকজন পানিবন্দি অবস্থায় চরম দুর্ভোগে রয়েছে। দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার বিতরণ করা হলেও তার অপ্রতুল। সদর উপজেলার ইসলামাবাদে পানিতে ডুবে এক শিশুর মৃত্যু হয়।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সদর উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়ন কমবেশি বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঈদগাঁও, জালালাবাদ, চৌফলদন্ডী, পোকখালী বেশি আক্রান্ত হয়েছে। তবে বৃষ্টি কমে আসায় পানিতে অধিকাংশ নেমে গেছে।’
তিনি জানান, বন্যায় আক্রান্তদের মাঝে জেলা প্রশাসন থেকে এক লাখ টাকা, ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এগুলো বিতরণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়ন, রাজাখালী, মগনামাসহ তিনটি ইউনিয়নের কিছু বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এতে সহ¯্রাধিক বসতবাড়ি ডুবে লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়ে। তবে বৃহস্পতিবার পানি অধিকাংশ নেমে গেছে।
আবহাওয়া অধিদফতর কক্সবাজার কর্মকর্তা এ কে এম নাজমুল হক জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অতি ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকে। সর্বশেষ সময় পর্যন্ত মোট ৫৩১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন জানান, বন্যা কবলিত পাঁচ উপজেলা জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা, ১০ মেট্টিক টন চাল ও ২০০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আরো বরাদ্দ দেয়া হবে।’ বন্যায় বসতবাড়ি, ফসল ও বীজতলা এবং বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।