ইমাম খাইর, সিবিএন
ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত না শুকাতে আবারো জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ী ঢলের পানিতে উপকূলীয় এলাকা পানির সাথে একাকার হয়ে গেছে। বিপদসীমার উপর পানি চলাচল করছে। ঢলের পানি ও পাহাড় ধসে দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। অবিরত বর্ষণে ভেঙে খানখান হয়ে গেছে চলাচলের রাস্তাঘাট। বসতবাড়ীতে ঢুকে পড়েছে ঢলের পানি। টানা বর্ষণে অনেক জায়গায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। উপড়ে গেছে গাছপালা-ক্ষেতখামার। স্বাভাবিকের চেয়ে বানি বেড়েছে ৪/৫ ফুট।
আবহাওয়া অধিদফতর কক্সবাজার স্টেশনের আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক বলেন, রোববার সকাল থেকেই ভারি বর্ষণ শুরু হয়ে এটি মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত অতি ভারি বর্ষণ হিসেবে অব্যাহত ছিল। রোববার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২৩১ মিলিমিটার। এভাবে বর্ষণ আরও দুইদিন অব্যাহত থাকতে পারে।
অতিবৃষ্টির তোড়ে জেলার মিঠাপানির তিন নদী চকরিয়ার মাতামুহুরি, ঈদগাঁওর ফুলেশ্বরী ও কক্সবাজারের বাঁকখালীতে নেমেছে পাহাড়ি ঢল। ঢলের তীব্রতায় ভেঙে গেছে ঈদগাঁওর রাবার ড্যাম এলাকার নদীর বাঁধ। এতে প্লাবিত হচ্ছে বৃহত্তর ঈদগাঁওর জালালাবাদ, ঈদগাঁও, চৌফলদন্ডী, পোকখালী ও ইসলামাবাদ এলাকার অর্ধশত গ্রামের রাস্তা-ঘাট, বাসা-বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ফসলের মাঠ। ভাঙনের কবলে পড়েছে আভ্যন্তরীণ সড়কও। একই অবস্থা বিরাজ করছে কক্সবাজার শহরসহ চকরিয়া, পেকুয়াসহ বেশ কয়েক উপজেলার নিম্নাঞ্চল। ঢলের তীব্রতা বাড়তে থাকায় নামতে পারছে না সমতলের বৃষ্টির পানি। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়ছে জেলার নিুাঞ্চলের শতাধিক গ্রামের কয়েক লাখ মানুষ। পাউবোর নিয়ন্ত্রণাধীন ২৭নং স্লুইচ গেইটটি বন্ধ করে রাখায় উজান থেকে নেমে আসা পানি বের হতে পারছে না। পাউবোকে একাধিকবার তাগাদা দিলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় বৃহত্তর ঈদগাঁওর প্রায় অর্ধশত গ্রাম পানিবন্দি।

ভাঙনকৃত এলাকা পরিদর্শন করেন জালালাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান ইমরুল হাসান রাশেদ।

অনেক স্থানে নদীর বেড়িবাঁধ ভাঙন শুরু হয়েছে। মেরামত সম্ভব হয়ে না উঠায় সহজে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। প্লাবিত হচ্ছে কক্সবাজার শহরের হোটেল-মোটেল জোন, ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দেরপাড়া, সদরের খরুলিয়া, দরগাহপাড়া, পোকখালীর মধ্যম পোকখালী, নাইক্ষংদিয়া, চৌফলদন্ডী, নতুনমহাল, ফুলছড়ি, ইসলামপুর, ঈদগাঁওর মাইজপাড়া, ভাদিতলা, ভোমরিয়াঘোনা, কানিয়ারছরা, ঈদগাঁও বাজার এলাকা, কালিরছড়া, রামুর উপজেলার ধলিরছরা, রামুর রশিদনগর, জোয়ারিয়ানালা, উত্তর মিঠাছড়ি, পূর্ব ও পশ্চিম মেরংলোয়া, চাকমারকুল, কলঘর, লিংকরোড়, চকরিয়ার উপজেলার খুটাখালী, চিরিঙ্গার ভাঙারমুখ, ফাঁসিয়াখালী, মালুমঘাট, ডুলাহাজারা ও পেকুয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা। প্লাবিত হয়েছে মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল। পেকুয়া সদর ইউনিয়নের পূর্ব মেহেরনামা, মোরার পাড়া ও শীলখালী ইউনিয়নের হাজীর ঘোনা, মাঝের ঘোনা, জারুলবনিয়া গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। বরইতলি-মগনামা সড়কের ১কিলোমিটার অংশ (সালাউদ্দিন ব্রীজ এলাকা থেকে পঁহরচাদা মাদ্রাসা পর্যন্ত) পানিতে ডুবে থাকায় বন্ধ রয়েছে চকরিয়া-পেকুয়ার যান চলাচল।
এদিকে মঙ্গলবার সকালে অতি বৃষ্টিপাতে পাহাড়ের মাটি চাপায় মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নের মোহরাকাটা গ্রামের জুমপাড়ার মনোয়ার আলম (৩৮) মারা গেছেন। বাড়ি রক্ষা করতে গিয়ে তিনি মাটিচাপা পড়েন।
ঢলের পানিতে ডুবে উম্মে সালমা (৭) নামের এক স্কুলছাত্রী মারা গেছে। সে ইসলামাবাদ পূর্ব ইউছুপেরখীল এলাকার আলী আব্বাসের মেয়ে ও ইউছুপেরখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
সদরের জালালাবাদ রাবার ড্যাম সংলগ্ন বিরাট এলাকা এখন পুরোপুরি ঝুঁকির মুখে। প্রবল স্রোতে স্থানীয় মনজুর মেম্বারের ঘাটা পয়েন্ট ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গন এলাকা দিয়ে ঈদগাঁও খালের বন্যার পানি অনুপ্রবেশ করায় ২ নং ওয়ার্ডের পূর্ব লরাবাক, ছাতিপাড়া এবং বৃহত্তর পালাকাটা ও বাহারছড়া এলাকার শত শত ঘরবাড়ী পানিতে তলিয়ে যায়। জলছেনা চুলার আগুন। দেখা দিয়েছে খাদ্য ও পানীয় জলের সংকট। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে ওই ইউনিয়নের ৯ ওয়ার্ড এবং ১নং ওয়ার্ডের তেলী পাড়া ও মাছুয়াপাড়ার বেড়ীবাঁধ সংলগ্ন এলাকা। জালালাবাদের রাবার ড্যাম এলাকার ভাঙ্গন এলাকাটি শ্রীঘ্রই মেরামতের ব্যবস্থা করা না হলে ২ নং ওয়ার্ডের কয়েকশ পরিবার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছে স্থানীয়রা।

প্লাবিত এসব এলাকা পরিদর্শন করেছেন কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্ণেল (অব.) ফোরকান আহমেদ, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম রহিমুল্লাহ, পানি উন্নয়নবোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান। কবলিত এলাকা রক্ষায় তারা দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন বলে জানান।
এসময় জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান সোহেল জাহান চৌধুরী, জালালাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান ইমরুল হাসান রাশেদ, সদর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রাজিবুল হক চৌধুরী রিকো, ঈদগাহ্ পৌরসভা বাস্তবায়নের আন্দোলনের সভাপতি কাফি আনোয়ার, জালালাবাদ ইউপি সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান ওসমান সরওয়ার ডিপো, সদস্য আরমান উদ্দিন, সাইফুল হক, মোফাচ্ছেল, সেলিম উদ্দিন, মোক্তার ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরেন। একইদিন বিকেলে রাবারড্যাম ভাঙ্গন আর ভোমরিয়াঘোনা পানিবন্দি এলাকা পরিদর্শন করেন কক্সবাজার সদর রামু আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা লুৎফুর রহমান কাজল।
জালালাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান ইমরুল হাসান রাশেদ জানান, ঈদগাঁও বাজার ফরাজীপাড়া সড়কের পূর্ব লরাবাগের হাফেজখানা পয়েন্ট দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচলে চরম বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। ভেঙ্গে গেছে জালালাবাদের পালাকাটা এলাকায় অনেকের বসত বাড়ি। ভেসে গেছে গৃহস্থালী সামগ্রী। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরকারের পক্ষ থেকে জরুরী ভিত্তিতে ত্রাণ তৎপরতা শুরুর দাবী জানিয়েছে এলাকাবাসী।
এদিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ায় ঈদগাঁও বাজারের অবস্থাও অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। সড়ক, উপ-সড়কগুলোতে জমে আছে ময়লাক্ত পানি। ডিসি সড়কের তেলীপাড়া রাস্তার মাথা থেকে বঙ্খিম বাজার পয়েন্টটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ। এই সড়কে বড় বড় গর্তের কারণে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আলমাছিয়া মাদ্রাসা গেইট পর্যন্ত সড়কটির অবস্থা খুব নাজুক।
উপকুলীয় জনপদ পোকখালী ইউনিয়নের গোমাতলী গ্রাম জোয়ারের পানিতে আবারও তলিয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার কারনে ওই এলাকার কয়েক হাজার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে কার্যত পানিবন্দী অবস্থায় জীবন যাপন করছেন। ইসলামপুর, চৌফলদন্ডী এবং ভারুয়াখালীর নিম্নাঞ্চল এখন পানির নিচে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নজরুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন।
এদিকে টানা ভারী বর্ষণে মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে পাহাড়ি ঢলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। মাতামুহুরীরর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন উপজেলার হাজারো পরিবার।
চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে পৌরসভার একাধিক নিমাঞ্চল। গতকাল দুপুর থেকে এক নম্বর বাঁধ এলাকা হয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে নদীর পানি। স্থানীয় মজিদিয়া মাদরাসাসহ আশপাশ এলাকার অন্তত শতাধিক পরিবারের বসতঘরে পানি ঢুকে পড়ার কারনে লোকজন দুর্ভোগে পড়েছে।
উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, ভারী বর্ষণের কারনে মাতামুহুরী নদীতে বেড়ে চলছে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি। ইতোমধ্যে নদীর পানি ঢুকে তাঁর ইউনিয়নের শতাধিক পরিবারের বসতঘর প্লাবিত হয়ে পড়েছে।
বরইতলী ইউপি চেয়ারম্যান জালাল আহমদ সিকদার বলেন, ভারী বৃষ্টিপাতে মাতামুহুরী নদীতে গতকাল সকাল থেকে পানি প্রবাহ বেড়েছে। এ অবস্থার কারনে নদীর শাখা খাল হয়ে তাঁর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর, ডেইঙ্গাকাটা, রসুলাবাদসহ একাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে গেছে। এলাকার দুর্গত জনসাধারণ বর্তমানে পানিবন্দি হয়ে পড়ার কারনে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে।
কোনাখালী ইউপি চেয়ারম্যান দিদারুল হক সিকদার ও বিএমচর ইউপি চেয়ারম্যান এসএম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ভারী বর্ষণের ফলে মাতামুহুরী নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় নদীর তীরবর্তী নীচু এলাকার লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে পানি। এ অবস্থার কারনে দুই ইউনিয়নের হাজারো পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

পেকুয়ায় সড়কে পানি চলাচল। মানুষ চড়ছে ভ্যানে।

চিরিঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন বলেন, দুইদিনের ভারী বৃষ্টিপাতে মাতামুহুরী নদীতে পাহাড়ি ঢলের প্রবাহ বেড়েছে। এ অবস্থার কারনে উপজেলার চিংড়িজোনের শত শত চিংড়ি প্রকল্প পানিতে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তিনি বলেন, বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে চিংড়ি প্রকল্প তলিয়ে গেলে মাছ ভেসে গিয়ে বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হবে চিংড়িজোনের হাজারো চাষী।
কক্সবাজার পানি উন্নয়নবোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সবিবুর রহমান সিবিএনকে জানান, হঠাৎ ভারী বর্ষণের কারণে পুরো জেলার অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবে গেছে। সদরের বৃহত্তর ঈদগাঁও এলাকায় প্রায় দেড়শ ফিট বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। চকরিয়ার মাতামুহুরীর নদীর পানি ৯৬ সে.মি এর উপরে বেড়েছে। প্লাবিত এলাকার খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। একটু পানি কমলে সংস্কার করা হবে বলে তিনি জানান।