এম শহিদ উদ্দিন (সোহেল)
১৯৩১সালে কাজী নজরুল ইসলাম গানটি রচনা করে শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের কন্ঠে এই গান রেকর্ড করার সময় কবি নাকি খুব শংকিত ছিলেন আদৌ এই গান জনপ্রিয় হবে কিনা ? কারণ ইতিপূর্বে এই ধাঁচের বাংলা গজল আর রচিত হয়নি। কিন্তু আজ বাংলাভাষী মুসলিমজাতির জন্য এটি ঈদ আনন্দোৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ।
নজরুল বিয়োগের প্রায় চারদশক পরেও ঈদ উৎসবে বিপণী কেন্দ্রগুলো এই গান বাজিয়ে ঈদের আগমনী আবহ সৃষ্টি করে। পথচারী, শিশুকিশোর, কিংবা শপিং ব্যাগ হাতে নারী পুরুষ এই অতি পরিচিত শ্রুতিধর সুরের তালে তালে কখনো বা নিজের অলক্ষ্যে ঠোঁট মিলায়।এর সুরের ব্যঞ্জনা মূর্ছিত করে সকল বয়সী মানুষকে। ঈদের দিনে সব টিভি চ্যানেল গুলোতে উচ্ছ্বাসিত ও অভিন্ন সুরে গাওয়া হয় এই গান। এর স্নিগ্ধতা ও ঝংকৃত সুরের মূর্ছনা কিছু মানুষের কাছে বিস্মৃত সব অনুভূতির মাঝে উচ্ছকিত দৃঢ় বিশ্বাসের দোলা দেয়। অনেকে আবার এই গানকে নেহাত বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে নেয়। অবশ্য যে কোন গানের সুর – ছন্দ বিনোদনের মাধ্যম । তবে কিছু গানের শব্দ চয়ন, গাঁথুনি, বাক্যলংকার কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়। প্রতিটি বাক্যের নিগুঢ় তাৎপর্য চিন্তাশীলদের হৃদয় ছোঁয়ে যায়। আলোচ্য গানটি এই প্রকারের। যার অগ্রভাগে এক মাস রোজাপালন শেষে ঈদের আগমন ও আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার পাশাপাশি আমাদের করণীয় কিছু ম্যাসেজ চমৎকার ভাবে বিবৃত হয়েছে ।
নিম্নে কিছু আলোকপাত করছি।
১.নিজের জন্য যা পছন্দ করি অন্যের ক্ষেত্রে তা করতে যেন কার্পণ্য না করে নিজেকে অন্যের মাঝে আবিস্কার করি।
“তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ”
২.আমাদের অর্জিত সব সম্পদ আল্লাহ প্রদত্ত। সুতরাং এই সম্পদ তার সৃষ্টির কল্যাণে যেন ব্যয়িত হয়। “তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ”
৩. আমরা যেন সম্পদের পূর্ণ হিসাব করে যাকাত দিই। যাকাত গরীবের প্রতি বিত্তবানদের কোন অনুগ্রহ নয়। বরং এটি সম্পদশালীদের নিকট নিঃস্বদের অধিকার। নিঃস্ব অভাবগ্রস্তদের এই অধিকার ফিরিয়ে না দিয়ে আমরা নিজেরা নিজের অজান্তে অবচেতন ভাবে যাকাত গ্রহীতা হয়ে ফকির মিসকিনের কাতারে শামিল হয়ে যায়। কবি এই ঘুমন্ত মুসলিমদের ঘুম ভাঙ্গানোর সুর তুলেছেন
এই গানে – ” দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ”।
৪. ঈদ গাহের এই ময়দান আবাদ করতে গিয়ে অনেক মুসলিম বীর শহীদ এবং আহত হয়ে গাজী হয়েছেন। আমাদের সেই চিরায়ত ঐতিহ্য যেন সদা স্মরি, মন থেকে যেন গৌরবের ইতিহাস কস্মিনকালে ভুলে না যায়।
“আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ”
৫. নামাজ সমাপ্তিতে বন্ধুর পাশাপাশি শত্রুদেরকেও বাহুডোরে অালিঙ্গনের মাধ্যমে সকল হিংসা – বিদ্বেষের কবর রচনা করে শান্তিময় দেশ গড়ি। জঙ্গীবাদ, ফন্দিবাজ, মতলববাজ ও ধান্ধাবাজের মুরীদ না হয়ে প্রকৃত ইসলামের শোভায় নিজকে শোভিত করি। “আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ, হাত মেলাও হাতে, তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ”।
৬. পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনাহারী অর্ধাহারী ক্ষুধাতুর মানব সন্তানের হররোজ রোজা তাদের ক্ষুধার এই কষ্ট আমরা এক মাস রোজাপালনের মাধ্যমে অনুভব করি ঠিকই। বছরের বাকী এগারমাস আমরা উদরপূর্তি করতে গিয়ে তাদের কথা যেন ভুলে না যাই। তাদের প্রতি সহায়তার হাত প্রসারিত করি।
“যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ”
৭. মুসলমানের মূল মন্ত্র তৌহিদ ( একত্ববাদ ) থেকে যেন বিচ্ছিন্ন না হয়। “ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের, তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ”।
৮.প্রাত্যহিকতায় আমরা যখনি মন্দের মুখোমুখি হয়, মন্দকে ভাল দিয়ে যেন জয় করি। দুষ্ট লোকদের ছোড়া কংক্রীট দিয়ে মসজিদ সদৃশ যেন সৌধ নির্মাণ করি। শেষ দু’ লাইনে এই ছিল আহ্বান-
“তোরে মারল’ ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ”।
প্রাণের উচ্ছ্বাস এই ঈদের সর্বাধিক জনপ্রিয় গানকে শুধু গাওয়ার মধ্যে শেষ না হউক। গাওয়া থেকে হউক নেওয়া। গান থেকে লুফে নেয়া আলোকচ্ছটায় প্রতিবিম্বিত হোক প্রতিটি জীবন। মসৃণ হোক মানবতার পথ চলা।
লিখক: ব্যাংক কর্মকর্তা।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।