তানভিরুল মিরাজ রিপন
রাতে চারটা অভিধান ভাজ করে রাখলাম।বাবা নিয়ে লিখেছে দুচারটে বই ভাজ করে রাখলাম।আরো একটা বই সাথে রেখেছি “বিকাশ মনোবিজ্ঞান” একজন সন্তান তার বেড়ে উঠা থেকে শুরু করে পরিপূর্ন বয়স,বৃদ্ধ হওয়া পর্যন্ত সবকিছুর আলোচনা এই বইয়ে আছে। এই বইটি সাথে রাখার কারন হলো একজন বাবার কি কি ভূমিকা থাকে বা থাকেনা।কোথায় বাবার কোন কোন ধরনের ভূমিকা রাখতে হবে সে বিষয়গুলো খোলামেলা আলোচনা করেছেন।সকালে ঘুম থেকে উঠে লিখতে বসে যাবো,যা আসে তা লিখবো বাবাকে নিয়ে।কারন আজ বাবা দিবস। সকাল হলো ( Bangla Academy Bengali-English Dictionary -1994) অভিধানের “ব”অধ্যায়ে “আ-কার”এর অনুচ্ছেদে একটা শব্দ খুঁজছিলাম যেটি “বাবা”।এই অভিধানের (৪৯৬-৫৯৬)এর কোন পৃষ্টায় আমি বাবা’র অর্থ পাইনি।তখন একই বইয়ের “প” অধ্যায়ে গিয়ে (ই-কার)অনুচ্ছেদ এ “পিতা” শব্দটির অর্থ খুজলাম (৩৮৭-৪৮২) পৃষ্টার ভেতরে যে “প” অধ্যায়টি রয়েছে সে অধ্যায়ের (ই-কার)অনুচ্ছেদের ৪৩১ পৃষ্টায় আমি “পিতার “অর্থ ইংরেজীতে যে সাধারন শব্দটি রয়েছে সেটি খুজে পেয়েছি “পিতা-Father(ফাদার্)” এই শব্দটির একটি শব্দ পর আমি আরো একটা শব্দ খুজে পাই “পিতৃ” যার ইংরেজী অর্থগুলো আমি লিখছি না,বাংলার্থগুলো লেখছি”আজ্ঞা,ঋণ,কার্য,কুল ইত্যাদি।শ্রদ্ধেয় রবিশঙ্কর মৈত্রী’র লেখা”আধুনিক বাঙলা বানান-অর্থ-উচ্চারণ অভিধান”বইটিতে আমি বাবা শব্দটির অর্থ পাইনি। কিন্তু পিতা শব্দটির কয়েকটা সমার্থক শব্দ দেওয়া ছিলো।আরো বিস্তারিত জানার জন্য আমার স্মার্টফোনে যে অভিধানটি আছে সেটিতে সার্চ দিলাম “বাবা” লিখে অনেকগুলো অর্থ আসলো।
এতোটুকুতেই আমার বাবা, বাবা শব্দটি প্রথম পাঠের চিত্রওয়ালা বইয়ে শার্ট প্যান্ট পরা একজন পরিপাটি পুরুষ।নতোবা সিনেমার সবচেয়ে দুঃখ চাষের একজন পুরুষ,নতোবা বিভিন্ন সিনেমায় দেখা তো যায় আবার বাস্তব জীবনেওতো এমন কিছু পিতা বা পুরুষ আমরা দেখি যারা সন্তানের পাপকে পাপ বলে স্বীকৃতি দেইনা বরং ছেলেমানুষি অভ্যেস বলে উড়িয়ে দিতে আমরা দেখেছিতো।রেইনট্রি হোটেলে ঘটে যাওয়া ঘটনায় আটককৃত অপরাধীর বাবা “আপন জুয়েলার্স”মালিক দিলদার’কে আমি তেমনভাবে একজন খলবাবা হিসেবে দেখেছি, পড়েছি।
কলেজ জীবনের কথা-
সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা চলছিলো চারটে ইভেন্টে আমি অংশগ্রহন করেছি,সে চারটে ইভেন্টেই আমি প্রথম হয়েছি।পুরস্কার বিতরনি অনুষ্ঠান কলেজ প্রধান অতিথি করে এনিছিলেন চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক “সুমন বড়ুয়া” একের পর এক সার্টিফিকেট আর পুরস্কার যখন আমার হাতে তুলে দিচ্ছেন তখন তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন”বাবা কি করেন?উত্তরে আমি বলছিলাম বাবা “নাই”। “নেই” আর “নাই” শব্দ দুটোতে উচ্চারণ গতো আবেগ,আর সম্মান হারিয়ে ফেলা,অভিমান লুকিয়ে থাকে।তিনি একটা বাবাকে নিয়ে গল্প বলেছিলেন-আমার যে কজন গুনীব্যক্তিত্ব্যের কথা বা বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছে,তন্মধ্যে এটি অন্যতম-“আমরা আমার বাবার জুতোকেও প্রনাম করতাম”।তাহলে এই ভদ্রজনের দৃষ্টিতে তার বাবা কতো টা উত্তম?সেটা আপনারাই বুঝে নিবেন।
মাইকেল জ্যাকসনের একটা বক্তৃতা অনুবাদ করেছিলাম বাংলায়।এই অনুবাদ আমি যতোবারই পড়েছি ততোবারই একটা আবেগ,একটা শূন্যতা কাজ করেছিল আমার ভেতরে।অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীদের সামনে শরনার্থি শিশুদের নিয়ে একটা প্রজেক্ট নিয়ে বক্তৃতা করতে তিনি আবেগায়িত হয়ে গিয়েছিলেন,তার বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে।তাদের বাবা রাগী ছিলেন-কিন্তু প্রতিরাতে যখনই ঘরে ফিরতেন তখন তাদের জন্য চকোলেট নিয়ে আসতেন।এভানে অসংখ্য কাগজে গল্পে আমি আমার বাবাকে খুজি। আসলে বাবার চরিত্রটা বিশাল তুলনাহীন।আজ আমার বাবা যদি থাকতেন! আমি বাবার কাঁধে যে একবার ছড়তাম, বাবাকে ঘোড়া বানিয়ে যে একবার তুমুল ন্যাপোলিয়নের,আলেকজান্ডার এর স্বাদ নিতাম।হয়তো মোটা কাচের চশমাটা নাকের ডগায় দিয়ে বড় একটা শার্ট পড়ে বাবার মতোন টিচার সেজে যেতাম,নতোবা প্রথম হাটা শিখতাম বাবার আঙুল ধরে,একটু হামাগুড়ি দিতে যখন শেখতাম তখন বাবাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়ে হুট করে পড়ে ব্যথা পেয়ে কাঁদতাম বাবা এসে জড়িয়ে ধরতেন,অথবা যখন সবে হাটা শেখতাম তখনই বাবার বড় বড় জুতো জোড়া নিয়ে হাটতে গিয়ে নাক মুখ ফেটে রক্তাক্ত করে ফেলতাম। অথবা বাবা যদি থাকতেন আমি খুউব সাহসি হয়ে বলতাম বন্ধুদের বলতাম-“আমার বাবা আছে-এতো বড় বাবা আছে যে তোদের মারলে খুজে পাবে না।”এগুলো আবেগ নয়,বাস্তব শৈশব আমি আমার কাছ থেকে আমার বন্ধুদের যেমন দেখেছি।আজ বাবা যদি থাকতেন অকারনে ঝগড়া করে বসতাম।একেবারে ইচ্ছেমতো বলে বসতাম। ১৬-১৭ সালের অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত আমি ৮৭ টা মতো মাধ্যমিক স্কুলে যাবার সুযোগ হয়েছে।কেনো যাওয়া হলো সেটি অন্যবিষয়।ওখানের একস্কুলে বক্তৃতা করে প্রশ্নপর্বে এক ছাত্র আমাকে প্রশ্ন করেছিল।বাবাকে আপনি কেমন চোখে দেখেন?আমারতো বাবা নেই।আমি কিভাবে উত্তর দিবো!আমার কাছে বাবা মানে শুধু একটা শব্দ।মাত্রই শব্দ শুধু উচ্চারন করা যায়।চরিত্রটি দৃশ্যমান হতে দেখার আগেই আমার বাবা না ফেরার দেশে চলে গেলেন।আমি তাকে উত্তর দিলাম, এই উত্তর নিয়ে সন্তুষ্ট যদি না হও,তাহলে আমি বলবো আমি পিতাকে বুঝিনি।”আবার একবার বাবা হও!একবার ক্ষানিক ক্ষনের জন্য ফিরে এসো,আজ কেউ নেই তোমার শাস্তি থেকে বাচাবার জন্য,আজ কোন মায়ের আচল নেই।হৃষ্টপুষ্ট হাতে বড় একটা চ্যালাকাঠ হাতে নাও,ইচ্ছামতো মারো আমায়,যতোই মারবে ততোই মানুষ হবো,যতোই মারবে ততোই মানুষ হবো।আমি মানুষ হবার তৃষ্ণায় ভোগছি।”
ছোট কাল থেকে আমি অনেক পুরস্কার পেয়েছি,আবার আমি সার্টিফিকেট সংখ্যা অন্তত ১৫০ ছাড়িয়ে যাবে,জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছি।এখন হরেক ক্লাস আমার হয়েছে,বড় বড় গুনী ব্যক্তিত্বের সাথে আমার উঠাবসা হয়।ব্যর্থতার চেয়ে বড় বড় পাওনা আমার হয়েছে! কিন্তু বাবা নেই।সত্য বলতে আমি যতোবারই পুরস্কার পেয়েছি ততোবারই উল্লাস করেছি,কিন্তু বাবাকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস করতে পারিনি।বড় হয়ে যে শূন্যতা আজো বুকে লাগে,প্রতিবছরই কতো উৎসব বাঙালির ঘরে ঘরে লেগে থাকে।আমাদের ঘরেও থাকে উৎসব,এই যখন ঈদ আসে তখন সবারই হৈ ছৈ ধুম পড়ে যেতো আমি এমন রঙের শার্ট প্যান্ট নিবো,এমন পাঞ্জাবি নিবো!বাবার হাত ধরে ঈদের নামাজে যাবো।বাবাকে কদমবুসি করে জড়িয়ে ধরবো।হয়নি আমি জন্মের পরই বাবা খুব কঠিন রোগে ভোগছেন সময়ের বেশির ভাগ তিনি কাটিয়েছেন হাসপাতালের সফেদ বিছানায় শুয়ে।তাই কখনো বলা হয়নি বাবা আমার অমন জামা চাই,না হলে নিবো না।আমার অমন জুতো চাই,দেখো গত ঈদে আমাকে যে জুতো কিনে দিয়েছো সে জুতো আমাকে ছোট হয়,এবার আমি পছন্দ করে নিবো। না হয় নিবো না।ইচ্ছা হয় অনেকগুলো অভিযোগ নিয়ে বাবার সামনে ছোট ছোট পলকে চোখ নিচু করে বাবার পায়ের কাছে বসে বাবা “বাবা হওয়া কষ্টের না,সবাই ভুল বুঝে!”বলতে হয়।ঈদ আসে কতো ঈদ গেলো কখনো আমি ধুম ঈদ কাকে বলে বুঝতে চেষ্টা করিনি।আমি সব নাকচ করেছি।যার বাবা নেই,তার এসব থেকে কিচ্ছু হয় না।ঈশ্বরের প্রতি কড়া অভিমান আমার!একবার বাবার বুকের ধুকপুকানি শোনতে আমার ইচ্ছা হয়।বাবার পকেট কেটে দু-চারটে বই কিনতে আমারোও ইচ্ছে হয়।লাল কালো জামা,চড়া ফিতার জুতো কেনার ইচ্ছা আমারো হয়।বাবার আঙ্গুল ধরে হাটতে ইচ্ছে হয়,খুব ইচ্ছে হয়।যখন “চলো পাল্টাই”সিনেমাটা দেখছিলাম অনুপম রায়ের গান”বাড়িয়ে দাও তোমার হাত আমি আবার তোমার আঙুল ধরে হাটতে চাই।”অনুপম দা’কে খুব কাছ থেকে খুজে পেয়েছি।বাবা খুজে পাইনি।
সব শেষে একটা ঘটনা দিয়ে লেখাটা শেষ করবো-
আশফাক স্যার আমার রসায়ন শিক্ষক-“একবার বাবাকে প্রশ্ন করো,সুযোগ সাহস নিয়ে,বাবা টাকা গুলো আয় করতে কি কি করতে হয়?তোমার।”সেদিনের পর আমি ঠিকই একজন বাবা’কে দেখেছি যিনি তার সন্তানদের জন্য একটা নামি রেস্তরাঁয় কাজ করছে,আর এক ভদ্রজনের কারনে অকারনে “ম্যানেজার”থেকে মার খেলো।যে ম্যানেজার তার সন্তানের বয়সী হবেন।পৃথিবীতে বাবা আর মা’দের মতো অপমান আর কাউকে হতে দেখিনি।আমি আজীবন যাকে পাশে পাই তিনি আমার বড় ভাই।যার ঋণ বাবার মতোনই হুবহু চরিত্রে অভিনয় করছেন।
আমি বাস্তব,আমাতে বাস্তব।আমি আমাতে মেখেছি জন্মের জনক,যার হাড় গুলো আমার সিড়ি।যাতে ভালোবাসার শুরু হয়।আমি তো একজন বাবার সন্তান-আমি তো একজন বাবার সন্তান।
বাবা কে?আমাকে প্রশ্ন করো। উত্তর আমার কাছে!
বাবা হলো অদৃশ্য!খুবই অদৃশ্য! যাকে দেখা যায় না।শুধু প্রয়োজনে বুঝতে পারা যায়।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।