পাহাড়২৪.কম:
আঠারো বছর আগে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা থেকে জীবন আর জীবিকার তাগিদে রাঙামাটিতে এসেছিলেন সুহেল মিয়া,তুহিন মিয়া । দিনমজুরীর কাজ করেন,দৈনিক আয় ৫০০ বা ৬০০। কোন কোন দিন কাজ থাকে, কখনো থাকেনা। তবে গত মঙ্গলবারের পর থেকে প্রতিদিনই কাজের জন্য ডাক পাচ্ছেন না,আয়ও অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু চোখে বিষাদ আর হতাশা নিয়ে এই দুই তরুণ জানালেন,জীবনে এই প্রথম টানা আয় করতে ভালো লাগছে না। কারো কাছে বেশি টাকা চাইতে ইচ্ছে করছেনা, এমনকি টাকাও নিতে ইচ্ছে করছেনা। জানালেন, গত ১৮ বছর ধরে রাঙামাটিতে আছি,কিন্তু কোনদিন এমন ভয়াবহ ঘটবে বুঝতেও পারিনি। পরিচিত অনেক দিনমজুরের নি:স্ব হয়ে যাওয়ার ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে চোখ মুছছিলেন তারা দুজনই।

ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয়ের পথে রাঙামাটি
বৃহস্পতিবার রাঙামাটি শহরের প্রধান তিন বাজার তবলছড়ি,রিজার্ভবাজার,বনরূপা ঘিরে যে চিত্র দেখা গেছে,তা নি:সন্দেহ ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। একদিকে মৃত মানুষের জন্য স্বজনের হাহাকার আর অন্যদিকে বাজারে জিনিসপত্রের জন্য হাহাকারও যেনো কেয়ামতের দিন চলে এসেছে। বাজারে তরিতরকারি কিছু নেই। এক পোয়া মরিচের জন্য ১০ জনের মারামারি। এক লিটার তেলের জন্য হাতাহাতি মারামারি,ভয়াবহ পরিস্থিতির যেনো খুব সামান্য চিত্রই। গত দুইদিনে শহরের প্রায় প্রতিটি তেলের দোকান ও পেট্ট্রোল পাম্পে দেখা গেছে মারামারির চিত্র। কোথাও নেই জ্বালানি তেল । ফলে ধীরে ধীরে বন্ধ যাচ্ছে ব্যক্তিগত মোটর সাইকেল থেকে শুরু করে অন্যান্য সকল গাড়ি। জ্বালানি তেল না থাকায় ব্যক্তিগত ও অফিসিয়াল জেনারেটরগুলো ও বন্ধ হয়ে পড়ছে। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় জ¦ালানি তেলও আসতে পারছেনা শহরে। কবে আসবে তাও জানাতে পারলো না কেউই।

জ্বালানি তেল ব্যবসায়ি মেসার্স মিন্টু এন্টারট্রাইজের স্বত্বাধিকারি আব্দুল সাত্তার মিন্টু জানিয়েছেন, আমাদের স্টকে থাকা তেল শেষ। তেল চট্টগ্রাম থেকে আনার সব সড়ক পথও বন্ধ। এখন বিশেষ ব্যবস্থায় কাপ্তাই হয়ে নৌপথে তেল আনতে যে খরচ পড়বে তা বহন করা অসম্ভব আমাদের। এখন শুধুমাত্র প্রশাসনের সহযোগিতা পেলেই আমরা তেল আনতে পারবে,এছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। তেলের জন্য মানুষের যে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে তা সত্যিই বেদনাদায়ক।

বন্ধ সড়ক যোগাযোগ,চালু বিকল্প সড়ক
অর্ধশতাব্দী আগে কাপ্তাই বাঁধ চালু হওয়ার পূর্বে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক যখন চালু হয়নি,তখন রাঙামাটিতে মানুষ আসতো কর্ণফুলি নদী হয়ে কাপ্তাই থেকে লঞ্চ বা স্টিমার যোগে। প্রায় ৫৭ বছর পর আবার চালু হলো যেনো সেই পথটি। রাঙামাটির সাথে সকল পথের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার থেকে চালু হয়েছে রাঙামাটি-কাপ্তাই লঞ্চ রুটটি। চট্টগ্রাম থেকে মানুষ সড়কপথে কাপ্তাই আসছেন এবং সেখান থেকে লঞ্চে করে আসছেন রাঙামাটি। আবার একইভাবে রাঙামাটি থেকে লঞ্চে কাপ্তাই যাচ্ছেন এবং সেখান থেকে বাসে বা অন্য কোন উপায়ে যেতে পারছেন চট্টগ্রাম। জেলা প্রশাসকের বিশেষ উদ্যোগে রাঙামাটি লঞ্চ মালিক সমিতির উদ্যোগে সড়ক যোগাযোগ চালু না হওয়া পর্যন্ত রাঙামাটি শহর থেকে প্রতিদিন চারটি লঞ্চ রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই যাবে এবং কাপ্তাই থেকে রাঙামাটি আসবে দিনের বিভিন্ন সময়,এমনটাই জানালেন রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান।
জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, সড়ক ও জনপদ বিভাগ বলছে এক সপ্তাহের মধ্যে তারা সাময়িক চলাচলের জন্য রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কটি চালু করতে পারবে। কিন্তু এই সড়কে যান চলাচল চালু করার জন্য অনেক সময় প্রয়োজন। তাই আমরা বিকল্প উপায় হিসেবে পুরনো নৌপথটি আবার চালু করেছি। আশা করছি, এর ফলে মানুষের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমবে।

বাজারে আগুন,নেই পণ্যের সরবরাহ
এদিকে টানা বর্ষন,পাহাড় ধ্বস,মানবিক বিপর্যয়ের পর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় রাঙামাটি শহরে দ্রব্যমূল্যের সংকট তৈরি হয়েছে। জেলা শহরের বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেলো,নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মজুদ কমে এসেছে। যা আছে,তাও বিক্রি হচ্ছে চড়ামূল্যে। ২০ টাকা মূল্যে আলু বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়,৬০ টাকার মরিচ বিক্রি হতে দেখা গেছে ২০০ টাকায়। চালের বাজারও উর্ধ্বগতি দেখা গেছে। সবচে কমদামি চালের দামও ৪৫ টাকা বিক্রি হতে দেখা গেছে। একদিকে রোজায় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, আর তার উপর এখন যোগাযোগহীনতার সুযোগ নিয়ে কিছু অসৎ ব্যবসায়ি সিন্ডিকেট করে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এমন অবস্থায় বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক শহরের সবগুলো বাজারের ব্যবসায়িদের ডেকে এনে জরুরী সভা করে তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। বলা হয়েছে, কোন বাজারে কেউ যদি কোন পণ্য বাড়তি দামে বিক্রি করে তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে। ব্যবসায়িরা নেতারাও আশ^াস দিয়েছেন, উর্ধ্বমূল্যে বিক্রি না করার। তবে কে শোনে কার কথা। বিভিন্ন বাজার থেকে আসছে উর্ধ্বদামে বিক্রির সংবাদ।

এদিকে কাপ্তাই হ্রদে মাছ আহরণ বন্ধ থাকায় এতোদিন রাঙামাটির মানুষ নির্ভরশীল ছিলো রাঙামাটির বাইরে থেকে আসা মাছের উপর। কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে সেই মাছও আসছেনা। আবার দুর্যোগের কারণে গরু মহিষ জবাইও অনেকটা বন্ধ। ফলে ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে খাবারের সংকট। সবচে তীব্র হয়ে উঠেছে খাবার পানির সংকট। বিদ্যুৎ জ¦ালানির অভাবে জেনারেটর চালু করা যাচ্ছেনা,তাই বন্ধ শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা। ব্যক্তিগত পানির পাম্পগুলোও চালু করা যাচ্ছেনা। মোমবাতি ও কেরোসিনের সংকটে অন্ধকারেই জীবন কাটছে শহরবাসির।

সংকট মোকাবেলায় প্রশাসনের উদ্যোগ
এদিকে শহরের পানি সংকট মোকাবেলায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন থেকে একটি বড় জেনারেটর এর ব্যবস্থা করেছে জেলা প্রশাসন। বৃহস্পতিবারের মধ্যেই এই জেনারেটরটি রাঙামাটি পৌঁছানোর কথা। এই জেনারেটরটি আসলে শহরে আংশিকভাবে পানি সরবরাহ চালু করা যাবে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে। অন্যদিকে একইভাবে জ¦ালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রনালয় ঢাকা থেকে আরো একটি বড় জেনারেটর রাঙামাটি পাঠাচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান। তিনি জানিয়েছে,এই দুটি বড় জেনারেটর রাঙামাটি আসার পর চালু করা সম্ভব হলেই পানি সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হবে এবং একই সাথে পৌরসভা,ফায়ারসার্ভিস,উন্নয়ন বোর্ড এবং সওজ এর পানির ভাউচারগুলো দিয়ে শহরের পানি সংকট সমাধানে চেষ্টা করা হচ্ছে।