শাহেদ মিজান, সিবিএন:
বর্ষা আসার সাথে বৃষ্টি নেমে পড়েছে। বৃষ্টির সাথে ঘটছে ঘটছে পাহাড় ধসের ঘটনা। বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের গত কয়েকদিনে রাঙামাটি, বান্দরবানসহ সারাদেশে প্রায় দেড়’শ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। টেকনাফেও দু’জনের প্রাণহানি ঘটে। পাহাড় ধসে আরো বড় ধরণের বিপর্যয় ঘটার প্রবল আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই আতঙ্কে পাহাড়ে বসবাসকারীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ভর করেছে। আতঙ্কে অধিকাংশ পাহাড়বাসীর নির্ঘুম রাত কাটছে। তারপরও পরিবারগুলো সরে যাচ্ছ না। মৃত্যুর মুখে পতিত হলেও তারা রয়েছে অনড়। বিগত সময়ে পাহাড় ধসে করুণ প্রাণহানির ঘটনাও তারা আমলে নিচ্ছে না। তবে তারা বলছেন, তাদের যাওয়ার পথ নেই।
অন্যদিকে পাহাড়ধসে আরো বড় ধরণের বিপর্যয়ের আশঙ্কায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসনে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। পাহাড়ে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে উদ্যোগ শুরু করেছে প্রশাসন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্র মতে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বাস করা পরিবারগুলোকে সরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন পাহাড়ীদের সরে যেতে প্রশাসনের পক্ষ কঠোর ভাবে নির্দেশ দেয়া হলেও কেউ সরেনি। শেষে এবার প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিতে নিজেরা কাজ শুরু করেছে। ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিয়ে পুনর্বাসন করার কাজ শুরু হয়েছে। গত দিন ধরে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন বিশেষ উদ্যোগ সহকারে ঝুঁকিপূর্ণদের সরিয়ে নিচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার কক্সবাজার শহর, সদর উপজেলা, মহেশখালী, টেকনাফ, রামু ও উখিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পাহাড় কেটে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে পাঁচ লাখ লোক। তার মধ্যে কক্সবাজার শহরের ঘোনারপাড়া, বৈদ্যঘোনা, পাহাড়তলী, সাহিত্যিকা পল্লী, লারপাড়া, আর্দশগ্রাম, নতুন পুলিশ লাইন, কলাতলী, লাইটহাউস, টেকনাইফ্যা পাহাড়সহ ২০টি এলাকায় পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ। সবাই সেখানে পাহাড় কেটে বসতি গড়েছে। সদরের পিএমখালী, লিংকরোডেও পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে অনেক মানুষ। একই ভাবে টেকনাফের টেকনাফে ১৩টি পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছে ২০ হাজারের অধিক মানুষ। টেকনাফে ৩৯ হাজার একর বনভূমি রয়েছে। তার মধ্যে ১৫ হাজার একর বনভূমিতেই দখলদাররা বসতি গড়েছে। টেকনাফ পৌরসভার পুরাতন পল্লানপাড়া, ফকিরামুরা, কাদিরঘোনা, নাইট্যাংপাড়া, শিয়াল¬্যাঘোনা, শাইল্লাতলী, বরইতলী উঠনি, সদর ইউনিয়নের বরইতলী, কেরুনতলী, নতুন পল্লানপাড়া, মাঠপাড়া, জাহালিয়াপাড়া, সন্দরকিল্লা, রাজারছড়া, হাবিরছড়া, মিটাপানিরছড়া, হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া, জাদিমুরা, রঙ্গিখালী, মুরাপাড়া, পশ্চিম সিকদারপাড়া, নইন্যার জোম, ঘোনাপাড়া, পশ্চিম পানখালী, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের নয়াপাড়া, কম্বনিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া ও পশ্চিম কুতুবদিয়াপাড়া, আমতলীতে এসব মানুষ চরম ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। ২০০৮ সালের ৪ ও ৬ জুলাই টেকনাফের ফকিরা মোরা ও টুন্যার পাহাড় ধসে একই পরিবারের চারজনসহ ১৩ জন মারা যায়। সর্বশেষ গত তিনদিন আগে হোয়াইক্যংয়ে পাহাড় ধসে মারা গেছে বাবা-মেয়ে।
উখিয়ায় বনভূমির পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে বসবাস করছে প্রায় ২০ হাজার হতদরিদ্র পরিবার। বিগত সময়ে পাহাড়ধসে ১৫ নারী, পুরুষ, শিশু প্রাণ হারালেও সরেনি বসবাসকারীরা। প্রশাসন কোন পাহাড়ে বসবাসরত পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসনের কোন উদ্যোগ নেয়নি। উখিয়ায় ৩৪ হাজার ৪৫০ একর সরকারি বনভূমি রয়েছে। এখানকার ৬০ শতাংশ মানুষ সরকারি বনভূমির পাহাড়ের পাদদেশে ও পাহাড়ের পাশে সমতল ভূমিতে বসবাস করে। বিশেষ করে জালিয়া পালং ইউনয়নের জুম্মাপাড়া, অফিসপাড়া, সোনাইছড়ি, ডেইলপাড়া, নিদানিয়া, ইনানী, মোহাম্মদ শফির বিল, চেইনছড়ি, চোয়াংখালী, বোয়াংখালী, মাদারবুনিয়া, চেপটখালী, হলদিয়া পালং ইউনিয়নের মধুঘোনা, রুমখাঁ হাতির ঘোনা, খেওয়াছড়ি, পাগলিরবিল, বত্তাতলী, পূর্ব মরিচ্যা, মধুঘোনা, গোরাইয়ারদ্বীপ, রতœাপালং ইউনিয়নের ভালুকিয়া, তেলিপাড়া, গয়ালমারা, চাকবৈটা, করইবনিয়া, রাজাপালং ইউনিয়নের হরিণমারা, বাগান পাহাড়, বটতলী, ওয়ালাপালং, সিকদারবিল, গরুরবাজার, মাছকারিয়া, কুতুপালং পিএফপাড়া, দোছড়ি, পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল, তাজনিরমার খোলা, তেলখোলা, গৌজ ঘোনা, গয়ালমারা, পশ্চিম পালংখালী, জামতলী, মোছার খোলা এলাকার প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পাহাড়ে বসবাস করেন।
রামুতে পাহাড়ের পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে ২০ হাজারের অধিক পবিরার। উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের উত্তর ক্যাজর বিল, পশ্চিম ক্যাজর বিল, বেলতলী শিয়াপাড়া, জাউস পাড়া শিয়াপাড়া, পূর্ব জুমছড়ি, পশ্চিম জুমছড়ি, মন্যাকাটা, জারুলিয়াঝিরি, লোহার ঝিরি, হাজির পাড়া, খাইছাখেলা, জোরানিখোলা, ঘোনাপাড়া, হরিণ পাড়া, নারিচ বানিয়া শিয়াপাড়া, দক্ষিন থিমছড়ি, পূর্ব থিমছড়ি, কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের ফকিরনির চর, শহর আলীর চর, ফাঁক্রিকাটা মুরাপাড়া, কচ্ছপিয়া মুরাপাড়া, দোছড়ি দক্ষিণ কুল মুরাপাড়া, ওদাইয়াকাটা, বড় জামছড়ি নদীর পশ্চিমকুল পাহাড় পাড়া, বড় জামছড়ি নদীর পূর্ব পাহাড়পাড়া, মৌলভীকাটা নদীর পশ্চিমকুল পাহাড়পাড়া, কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের লট উখিয়ারঘোনা মুরারকাচা, পশ্চিম মনিরঝিল দরগাপাড়া, পূর্ব মনিরঝিল পাহাড়পাড়া, মইশকুম ও উখিয়ারঘোনা, রশিদনগর ইউনিয়নের লম্বাঘোনা, গোলাম আলীর ঝুম, হরিতলা, পূর্ব খাদেমর পাড়া, থলিয়াঘোনা ও পাহাড়তলী, ঈদগড় ইউনিয়নের উত্তর চরপাড়া, ধুমছাকাটা, চেংছড়ি, কোনার পাড়া বুরু¹্যার শিয়া, করলিয়া মুরা ও বৈদ্যপাড়া, জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের পূর্ব জোয়ারিয়ানালা মুরা পাড়া, নন্দাখালী মুরা পাড়া, উত্তর মিঠাছড়ি পাহাড়ীয়াপাড়া, পূর্ব নোনাছড়ি পাহাড়িয়া পাড়া ও ব্যাঙডেবা, রাজারকুল ইউনিয়নের ভিলিজার পাড়া, ঘোনারপাড়া, ছাগলিয়াকাটা, কাট্টলিয়া পাড়া, পশ্চিম ঘোনার পাড়া, চৌকিদার পাড়া, দক্ষিণ সিকদার পাড়া ও পাহাড়তলী, দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের খরুলিয়ারছড়ি, জিনরঘোনা, পানের ছড়া পশ্চিমকুল, সমিতি পাড়া, কালা খন্দকার পাড়া, ঘোনার পাড়া ও মোরাপাড়া এবং খুনিয়াপালং ইউনিয়নের দারিয়ারদীঘি, পশ্চিম দারিয়ারদীঘি, পশ্চিম দারিয়ারদীঘি, খুনিয়াপালং ও উত্তর পাড়া, পশ্চিম গোয়ালিয়াপালং, পশ্চিম ধেচুয়াপালং, পূর্ব ধেছুয়াপালং, পেঁচারদ্বীপ, হিমছড়ি, মাঙ্গালাপাড়া, দক্ষিণপাড়া, করাচিপাড়া, দরিয়ানগর এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে ও চূড়ায় ঝুঁকি নিয়ে এসব বসবাস করছে। গত বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধ্বসে রামুর কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের লট উখিয়ারঘোনা এলাকার আমির হোসেন (৩৫) ও রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের মিতার ছড়া এলাকার মো. রিদুয়ান (১০) প্রাণ হারিয়েছেন। চলতি বর্ষা মৌসুমে গত ১ সপ্তাহ ধরে ভারি বর্ষনে রামু কাউয়ারখোপ লট উখিয়া ঘোনাসহ বেশ কিছু স্থানে পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটছে।
মহেশখালীতে পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ। উপজেলার হোয়ানক, কালারমারছড়া, শাপলাপুর, ছোট মহেশখালী ও বড় মহেশখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে বন বিভাগের মালিকানাধীন পাহাড়ে বসতঘর গড় উঠেছে প্রায় ১০ হাজার। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিবছর বর্ষা এলে পাহাড় কেটে এসব ঘর তৈরি করা হয়। পাহাড়ে বসতি বেড়ে যাওয়ায় বর্ষায় পাহাড় ধসে প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ১৯৭০ সালের পর থেকে উপকূলীয় মাতারবাড়ি, ধলঘাট ও কুতুবদিয়ার লোকজন পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন করে আশ্রয় নেন। বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। গত পাঁচ বছরে এসব স্থানে পাহাড়ের ধসে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে পাহাড়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারী লোকজন সরিয়ে নিতে কার্যক্রম শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি পরিবারকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে অন্যদের সরিয়ে নিতে কাজ করা হচ্ছে। তবে প্রশাসনের তারপরও অধিকাংশ পাহাড়বাসী সরে যেতে অনড়। ওই লোকজন বলছেন, তাদের আর যাওয়ার কোন পথ নেই। তাই মরতে হলে তাদের পাহাড়ে মরতেই হবে।
লাইট হাউজ এলাকার আব্দু সাত্তার বলেন, ‘কোন রকম ধার দেনা করে দেড় লাখ টাকা দিয়ে ৩ গন্ডা পাহাড়ি জায়গা কিনেছি। এটি ছাড়া আর কোন সম্বল নেই। ঝড় বন্যা নয় প্রাণ গেলেও এই পাহাড় ছেড়ে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। আব্দু সাত্তারের মত ছৈয়দ নূর, রফিক আলমের অন্যান্য লোকজনেরও একই কথা।
তথ্য মতে, পাহাড় ধসে কক্সবাজারে গত কয়েক বছরে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। সর্বশেষ গত বছর শহরের রাড়ার হাউস সংলগ্ন কবরস্থান পাড়ায় ভয়াবহ পাহাড় ধসে শিশু-নারীসহ তিনজনের প্রাণহানী হয়। কিন্তু এরপরও পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস থেমে নেই। থামছে না পাহাড় কাটাও।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটি আন্দোলনের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘শেষ আশ্রয় হিসাবে পাহাড়ে বসতি গড়েছে অসহায় লোকগুলো। তাই তারা সেটি ছেড়ে কোনভাবে সরতে চায় না। পুনর্বাসনের মাধ্যমে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কেটে ঝুঁকিপূর্ণভাবে লক্ষাধিক মানুষ বসতি তৈরি করেছে। এসব এলাকায় পাহাড় কাটার অভিযোগে শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। অভিযান চালিয়ে জব্দ করা হয়েছে পাহাড় কাটার অনেক সরঞ্জামও। তারপরও পাহাড় কেটে বসতি গড়া অব্যাহত রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের একার পক্ষে পাহাড় কাটা বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন বলেন, ‘পাহাড়ে ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে নির্দেশ দেয়া হলেও সরে না। তাই এবার আমরা মাঠে নেমেছি। নিজেরা গিয়ে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের সরিয়ে নিচ্ছি। সকল উপজেলার ইউএনওদেও নির্দেশ দেয়াহ হয়েছে। এছাড়াও তাদের সরিয়ে যেতে নানাভাবে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনাটি ঘটে ২০১০ সালের ১৫ জুন। ওই দিন জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে অকালে ঝরে পড়েছিল সেনাবাহিনীর ৬ সদস্যসহ ৫৪ প্রাণ।