ইমাম খাইর, সিবিএন:
থাইল্যান্ড থেকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ এখন কক্সবাজার উপকূলে অবস্থান করছে। এটি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠছে। যে কোন মুহুর্তে কক্সবাজার সাগর উপকূলবর্তী এলাকায় আঘাত হানার আভাস দিচ্ছে আবহাওয়াবিদরা।
সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় আবহাওয়া অধিদপ্তর ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করেছে।
আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দুছ সোমবার রাত সাড়ে ১১ টায় সিবিএনকে জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ কক্সবাজার থেকে ২৮০ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৩১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। স্বাভাবিকের চেয়ে পানি ৬/৭ ফুট বাড়তে পারে। এটি মঙ্গলবার সকালের দিকে কক্সবাজার উপকূলের আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬২ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ৮৯ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১১৭ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরসমূহকে সাত নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা আর বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত পৃথক প্রস্তুতি সভা করে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়-ক্ষতি প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়টি সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে মাত্র ৩৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। এটি কক্সবাজারের কুতুবদিয়া হয়ে হাতিয়া ও স্বন্দীপে আঘাত হানতে পারে। তাই বিকেল থেকে কুতুবুদিয়ার উত্তর ও দক্ষিণ ধুরুং, আলী আকবর ডেইল এলাকাসহ পুরো উপজেলায় ৫২৫ জন স্বেচ্ছাসেবক এলাকার লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে কাজ করছে। রাতেও ফলোআপ মিটিং করে জেলা প্রশাসন। এদিকে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে। বেড়েছে পানির প্রবাহ। ঢেউয়ের তোড়ে ভাঙছে কক্সবাজার সৈকতের বালিয়াড়ি ও ঝাউবিথী। তলিয়ে যাচ্ছে বালিয়াড়ির ‘ওয়াকওয়ে’।
জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জানানো হয়, উপকূলের অন্তত তিনলাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে আনার সিদ্ধান্তের পর কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। দুর্যোগকালীন সময়ে নিরাপদে নিয়ে আসা লোকজনের জন্য সেহেরি ও ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথম সভার পরপরই উপকূলবর্তী এলাকাসমূহে দুপুর ১টা থেকে ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ সংকেত ও সম্ভাব্য ভয়াবহতা নিয়ে চলছে সতর্কতামূলক মাইকিং।
কক্সবাজারের ৮টি উপজেলার সাধারণ মানুষের কাছে দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামসহ মেডিকেল টিম গঠনসহ সর্বাÍক আগাম প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ছুটিতে থাকা চিকিৎসক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করেছে প্রশাসন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, উপকূলের ৫৩৭টি আশ্রায়ন কেন্দ্রকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া ঘোষণা দেয়া হয়েছে উপকূলবর্তী সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অস্থায়ী আশ্রায়ন কেন্দ্র। পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থার পাশাপাশি ৪ হাজারের অধিক স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে ৮৮টি মেডিকেল টিম। খোলা হয়েছে উপজেলা পর্যায়ে কন্ট্রোল রুম।
জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানান, এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় হওয়ায় গত উন্নয়ন সমন্বয় ও জেলা আইন-শৃঙ্খলা মিটিংসহ সব বৈঠকে আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করার পরামর্শ সংশ্লিষ্ট সকলকে দেয়া হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ উপকূলে আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সন্ধ্যার আগে পাহাড়ের পাদদেশে থাকা ও উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত জনসাধারণকে সরিয়ে আনার নির্দেশনা নিয়ে কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা। খোলা রাখা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো। শুকনো খাবার মজুদ ও সংরক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, উদ্ধারকারী দল, দমকল বাহিনী, রেড ক্রিসন্টে সদস্যদের স¤পূর্ণভাবে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, উপকূলীয় এলাকা থেকে আশ্রয় কেন্দ্রে আগত জনসাধারণের যানমাল ও স¤পদ রক্ষার্থে আনসার-ভিডিপি সদস্যদেরকে পাহারায় থাকা, সমুদ্রে যাওয়া মাঝধরা ট্রলার ফেরত আনা, জনসাধারণসহ সকল উপজেলায় উদ্ধার কার্যক্রমে ন্যস্ত সকল সদস্যদেরকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
বৈঠকে কুতুবদিয়ার প্রতিটি ইউনিয়ন, মহেশখালীর ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, কুতুবজুম, সদরের পোকখালী, চৌফলদন্ডী, খুরুশকুল, পেকুয়ার রাজাখালী, উজানটিয়া, মগনামা, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, সেন্টমার্টিন ও বাহারছড়া ইউনিয়নের লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেয়া হয়। যারা আসতে চাইবে না তাদের জোর করে নিয়ে আসার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের সভায় কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ সোমবার বিকেল নাগাদ কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে মাত্র ৩৪৫ কি.মি. দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি ক্রমে উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এটি সোমবার রাত নাগাদ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমের সময় উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এখন বাতাসের গতিবেগ কম থাকলেও সন্ধ্যার পর গতিবেগ বাড়তে পারে। ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালে জোয়ার থাকার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমনটি হলে উপকূলে জলোচ্ছাসের পরিমাণও বাড়তে পারে।
তিনি আরও জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর উত্তাল থাকায় বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা, ট্রলার এবং সমুদ্রগামী জাহাজকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে একটি নিুচাপ সৃষ্টি হওয়ার পর রোববার মধ্যরাতে সেটি ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাগর তীরের আট দেশের আবহাওয়া দফতর ও বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্যানেলের তালিকা অনুযায়ী তখন এর নাম দেয়া হয় ‘মোরা। আবহাওয়াবিদ নাজমুল জানান, ‘মোরা’ থ্যাইল্যান্ডের প্রস্তাবিত নাম। নিুচাপটি ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়ার পরপরই সমুদ্র বন্দরগুলোকে ২ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়। পরে ভোর ৬টায় সঙ্কেত বাড়িয়ে ৪ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত এবং ১০ টায় বিপদ সংকেত জারি করা হয়।
এদিকে বিপদগ্রস্ত মানুষগুলোর উদ্ধারে ছুটে যান কক্সবাজার সদর আসনের সাবেক এমপি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা লুৎফুর রহমান কাজল। তিনি নিজস্ব হোটেল নিরিবিলি উপকূলের মানুষদের জন্য সম্পূর্ণ উম্মুক্ত করে দিয়েছেন। সরবরাহ করেছেন শুকনো খাবার, সেহেরীসহ প্রয়োজনীয় সাহায্য। শহরের ১নং ওয়ার্ডের ২০ হাজার মানুষ শহরের বিভিন্নস্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এসব মানুষ শহরের পৌর প্রিপ্যারেটরি উচ্চবিদ্যালয়, পাবলিক হল, জেলা প্রশাসক কার্যালয় চত্বরে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়াও হাজার দু’য়েক মানুষ নুনিয়ারছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
মাহবুবুর রহমান চৌধুরী জানান, ১০ নং মহাবিপদ সংকেত হলে ইফতারের পর থেকে লোকজন আশ্রয়ে চলে আসে। সোমবার রাত ১০ টা নাগাদ ঝুঁকিপূর্ণ সব মানুষ নিরাপদে চলে এসেছে। অনেকে আবার বিভিন্ন হোটেলেও আশ্রয় নিয়েছে। তিনি জানান, আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য সেহেরীর খাবার দেয়া হবে। খিচুড়ি রান্না করে তাদের মাঝে বিতরণ করা হবে। এছাড়াও জরুরী প্রয়োজনী সামগ্রীও দেয়া হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, কক্সবাজারের উপকূলীয় উপকূলীয় এলাকা কুতুবদিয়ার সবকটি ইউনিয়নের নিচু এলাকা, মহেশখালীর ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, কুতুবজোমের ঘটিভাঙ্গা, তাজিয়াকাটা, শাপলাপুরের জেমঘাট, কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া এবং টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন ও পেকুয়ার বেশ উপকূলীয় এলাকার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে এসেছে। নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে চলা মানুষগুলো আশ্রয়কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও উচু জায়গায় ঠাঁই নিয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানিয়েছেন, অনিরাপদ স্থানে যেন একটা লোকও না থাকে সে ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।