হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ
ধেয়ে আসা ঘুর্ণিঝড় ‘মোরা’র প্রভাবে সাগরের পানি স্বাভাবিক মাত্রা অতিক্রম করায় নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে উপকূলে বাস করা মানুষ। ১০ নং মহা বিপদ সংকেত ঘোষণা করার সাথে সোমবার ২৯ মে ইফতারের পর থেকে আশ্রয়ে জন্য ছুটছে উপকূলের মানুষ। এর আগে বিকাল থেকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরে যেতে বলা হলেও সরেনি কেউ সরেনি। বিপদ সংকেত বেড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন উপকূলীয় সবকটি ইউনিয়নের নিচু এলাকার মানুষ ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ঘুর্ণিঝড় ‘মোরা’র প্রভাব থেকে বাঁচতে সোমবার সন্ধার আগেই উপকূলের সব লোকজনকে নিরাপদে সরে যেতে নির্দেশ দেয় প্রশাসন। কিন্তু এতে কেউ সরেনি। সংকেত বেড়ে যাওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলছে এসব মানুষ। নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে চলা মানুষগুলো আশ্রয়কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও উচু জায়গায় ঠাঁই নিচ্ছেন।
ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ বাংলাদেশের উপকূলের আরও কাছাকাছি ৩৪৫ কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছে। এটি মঙ্গলবার ৩০ মে সকাল নাগাদ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। এজন্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে।
সোমবার বিকেলে আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও কাছাকাছি এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ আরও সামান্য উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থান করছিল।
এটি সোমবার বিকেল ৩টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৮০ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘণীভূত ও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে মঙ্গলবার ৩০ মে সকাল নাগাদ চট্রগ্রাম-কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
সাগর উত্তাল থাকায় টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া সব ধরনের নৌযান কূলে ফিরতে শুরু করেছে।
২৯ মে সোমবার সকালে সবাইকে সর্তক থাকার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে টেকনাফ উপজেলায় মাইকিং করা হয়েছে। মাইকিংয়ে সাগরে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ও মাছ ধরতে যাওয়া সব ধরনের নৌযানকে কূলে ফিরতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি উপকূলের লোকজনকে স্ব-স্ব আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এদিকে বিশেষ করে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপের পশ্চিম মাথায় বেড়িবাঁধ না থাকায় ওই দ্বীপের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। এ বাধেঁর জন্য একনেকে ১০৬ কোটি বরাদ্দ হলেও এখনো কাজ শুরু হয়নি। ফলে গত ৫ বছর ধরে ওই এলাকার জনগোষ্ঠী মানবেতার জীবনযাপন করছে।
টেকনাফ-সের্ন্টমাটিন রুটের সার্ভিস বোটের সভাপতি রশিদ আহমদ বলেন এ রুটের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে দ্বীপে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যেতে পারেননি অনেক ব্যবসায়ী। ইউনাইটেড ল্যান্ডপোর্ট টেকনাফ বন্দরের সহকারী মহাব্যবস্থাপক জমিস উদ্দীন চৌধুরী বলেন বিপদ সংকেত থাকায় সকাল থেকে বন্দরের মালামাল উঠা-নামা বন্ধ রাখা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর কক্সবাজার স্টেশনের সহকারী আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ মঙ্গলবার ৩০ মে সকালে ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক বলেন বঙ্গোপসাগরে যেসব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার রয়েছে সেসব কূলে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং উপকূলের লোকজনকে সর্তক এবং আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তিনি বলেন উপজেলা সব আশ্রয় কেন্দ্রে প্রস্তুত রয়েছে। পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খোলা হয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী মজুদ রয়েছে। সব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের সর্তক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র প্রভাবে সাগর উপকূল প্রচণ্ড উত্তাল হয়ে পড়েছে। ২৯ মে সোমবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের প্লাবনে ৪০ গ্রামের কয়েক শ ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। এ কারণে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে হাজারো মানুষ। পাউবো সূত্র মতে জেলার টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া ও কক্সবাজার সদর উপজেলার পাউবোর ৫৯৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপে আড়াই কিলোমিটার, মহেশখালীর ধলঘাটা ইউনিয়নে দেড় কিলোমিটার, মাতারবাড়ি ইউনিয়নে ১০০ মিটার ও কক্সবাজার সদর উপজেলার পোকখালী ইউনিয়নের গোমাতলীতে ৮০ মিটারসহ পাঁচ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গেছে। এ ছাড়া জেলার পেকুয়া, কুতুবদিয়া উপজেলায় আরও সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে এসব অর্ধভাঙা ও নড়বড়ে বেড়িবাঁধ বিলীন হতে পারে।
পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন ঘূর্ণিঝড় মোরার প্রভাবে সকাল থেকে বঙ্গোপসাগর প্রচণ্ড উত্তাল হয়ে পড়েছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ-ছয় ফুট উচ্চতায় বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলে আঘাত হানছে। বিশেষ করে ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে কয়েকটি ইউনিয়নের ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে আরও বেড়িবাঁধ বিলীন হলে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যাও বাড়বে। জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পরিষদ সদস্য ও টেকনাফ উপজেলার পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. শফিক মিয়া বলেন মোরার প্রভাবে শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম অংশের ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানিতে সয়লাব হয়েছে আটটির বেশি গ্রাম। আড়াই বছর ধরে এখানে কোনো প্রতিরক্ষা বেড়িবাঁধ নেই। এ এলাকার ভাঙা বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য সরকার গত বছর ১০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও এ পর্যন্ত কাজ শুরু হয়নি। অন্যদিকে জোয়ারের ধাক্কায় উপজেলার খুরেরমুখ, সাবরাং, আছারবনিয়াপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় আরও কয়েক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এতে উপকূলের হাজার হাজার মানুষ উদ্বিগ্ন।
শাহপরীরদ্বীপের উত্তরপাড়ার বাসিন্দা জসীম উদ্দিন মাহমুদ বলেন দুপুরে জোয়ারের ধাক্কায় দ্বীপের পশ্চিমপাড়া, দক্ষিণপাড়ার শতাধিক বসতবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। এতে লোকজনের দুর্ভোগ বেড়েছে। মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, জোয়ারের প্লাবনে এই ধলঘাটা ইউনিয়নের অন্তত ১০টি গ্রামের শতাধিক ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। ইউনিয়নের প্রায় তিন কিলোমিটার ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ার-ভাটা চলছে। নিম্নমানের কাজ করায় বেড়িবাঁধ টেকসই হচ্ছে না।