শাহেদ মিজান, সিবিএন:
মহেশখালীর উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়ন। যে ইউনিয়নটির ‘ক্রাইমজোন’ তকমা দেশজুড়ে। দীর্ঘ দেড় দশক ধরে এই ইউনিয়ন জুড়ে সন্ত্রাসের রামরাজত্ব চলে আসছে। বিএনপি-আওয়ামী লীগ থেকে সূত্রপাত হওয়া প্রতিহিংসার দাবানল পারিবারিক গন্ডি ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত পর্যায় পর্যন্ত এসে ঠাঁই নিয়েছে। এই হিংসার বলী হয়ে দশ জনের বেশি মানুষ চলে গেছে পরপারে। শুধু তাই এক সময় আওয়ামী পন্থীরা এলাকাছাড়া থাকে। বর্তমান সরকারের চলমান টানা দু’মেয়াদে অনেক বিএনপি পন্থীরাও এলাকা ছাড়া হয়ে আছে। তবে দু’পক্ষ মুখোমুখী না থাকায় বিগত কয়েক বছরে কিছু স্থিতিশীলতা বজায় থাকলেও শান্তি ফিরেনি ‘সন্ত্রাসের জনপদ’ কালারমারছড়ায়। তারা এলাকায় অবস্থান করে তারাও প্রতিনিয়ত জীবন শঙ্কা নিয়ে সময় কাটায়। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি- কেউই এই শঙ্কা থেকে এখন পর্যন্ত মুক্ত নয়। এমন পরিস্থিতি ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচন ঘোষণা হলে আতঙ্কে নতুন মাত্রা নামে। কিন্তু এ যেন আতঙ্কের উপর আতঙ্ক! নৌকা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয় দু’জনের মধ্যে। নিজেদের নৌকার যোগ্য দাবি করে সাবেক চেয়ারম্যান ওসমান গণির পুত্র তারেক বিন শরীফ ও সেলিম চৌধুরীর মধ্যে শুরু হয় কাড়াকাড়ি। এই কাড়াকাড়ির যুদ্ধ উচ্চ আদালত গড়ায়। রীট-পাল্টা রীট দু’বার স্থগিত করা হয়। তবে শেষ যুদ্ধে সেলিম চৌধুরীর কাছ থেকে নৌকা কেড়ে নিতে পারেনি তারেক। এই নিয়েও পরিস্থিতি অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। পক্ষে-বিপক্ষে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এই উত্তেজনা নিয়ে সন্ত্রাসবাদ চাঙ্গা হয়ে উঠে আরো। যা শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পুন: তপশীল ঘোষণা ২৩ মে নির্বাচনের ভোট গ্রহনের তারিখ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এতে শতভাগ সংঘর্ষের আশঙ্কা মাথায় নিয়ে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয় প্রার্থীরা। তবে আশঙ্কা ছিলো আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিম চৌধুরী ও বিদ্রোহী প্রার্থী তারেক ওসমান শরীফকে ঘিরে। বিএনপি প্রার্থী এখলাসুর রহমানও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হলেও তাকে নিয়ে আশঙ্কা কম ছিলো।
স্থানীয় তথ্য মতে, দলীয় ভাবে নির্বাচন হলেও কালারমারছড়া ইউপিতে নির্বাচনে মূল নির্বাচনের প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী সেলিম চৌধুরী ও বিদ্রোহী প্রার্থী তারেক বিন ওসমান শরীফ। এই দু’প্রার্থী নির্বাচনের প্রচারণার শুরু থেকেই এই দু’প্রার্থী নানা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। সভা, মিছিল, ক্যাম্পিংসহ সব ভাবে দু’জন একে অপরের প্রতি বিষোদাগার ও হুমকি-পাল্টা প্রদর্শন করতে থাকে। তবে তা মারাত্মক সংঘর্ষে পর্যায়ে যায়নি। তবে সবার মূল আশঙ্কা ছিলো ভোটের দিন। কারণ মাঠের হিসেবে ভোটের দৌড়ে অনেক এগিয়ে ছিলো তারেক শরীফ। তাই তাকে ঠেকাতে নৌকার প্রার্থী সেলিম চৌধুরী প্রভাব বিস্তারসহ নানা ষড়যন্ত্র করবে- এমন আশঙ্কাটি পথে পথে ‘ঘুরে ফিরেছে’। এই জন্য ভোট দিনের জন্য দু’প্রার্থীর সন্ত্রাস মজুদের কথা কয়েক দিন আগেও থেকে চারিদিকে চাউর হয়ে যায়। তার চেয়েও বেশি গুজব উঠে সেলিম চৌধুরীকে জিতিয়ে দেয়ার জন্য চেষ্টা করা হবে। দলের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতারা এই কাজটি করবে বলে মাঠে ছড়িয়ে পড়ে। এতে জড়িয়ে যায় স্থানীয় সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিকের নামও। তবে শেষ খবর হলো, সব আশঙ্কা আর আতঙ্ক মিথ্যা প্রমাণ হয়ে ‘ক্রাইমজোন’ কালারমারছড়ায় দেশের আলোচিত একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো।
সীমাহীন আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়াকে স্থানীয়রা কল্পনাতীত দাবি বলে অবহিত করছেন সাধারণ ভোটাররা। তারা এই অবদানের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব প্রশাসনকে দিয়েছেন। ইউপি নির্বাচনে দেশের সব জায়গায় যেখানে সরকার দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট কারচুপির গুরুতর অভিযোগ সেখানে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিয়ে প্রশাসন কালারমারছড়া গণমানুষের আস্থা অর্জন করেছেন।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সকাল ৮টায় ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর থেকে কোনো ঝামেলা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়। প্রশাসনের কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে ভোটার কোনো বাধা ছাড়াই ভোটারাধিকার প্রয়োগ করেছেন। ভোট কেন্দ্রে আসা থেকে ভোট দিয়ে বাড়ি পৌঁছা পর্যন্ত একজন ভোটারও কোনো ধরণের অভিযোগ করেনি। ভোট কেন্দ্রের ভেতর কোনো প্রার্থীর একজনও লোককেও প্রভাব দেখাতে দেখা যায়নি। সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে প্রশাসনের লোকজন কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করেন। ভোট গ্রহণকারী নির্বাচন কমিশনের লোকজনও কোনো বাধার সম্মুখীন হননি বলে নিশ্চিত করেন।
এদিকে ভোটগ্রহণ ছাড়াও কেন্দ্রের বাইরে কোনো ধরণের একটি অপ্রীতিকর ঘটনারও খবর জানা যায়নি। পুরো ইউনিয়ন জুড়ে পক্ষ-বিপক্ষের কোনো লোকজনকে বাড়াবাড়ি করতে দেখা যায়নি। তবে সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়ানোর সাথে প্রধান সড়কের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে মোটর সাইকেলের প্রতীকের সমর্থকদের অবস্থান নিতে দেখা যায়। কিন্তু সে তুলনায় ধানের শীষ বা নৌকা প্রতীকের সমর্থকদের কোথাও চোখে পড়েনি।
মোটর সাইকেল প্রতীকের সমর্থকরা জানান, তাদের আশঙ্কা ছিলো নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে ভোট কারচুপি করা হবে। কারণ সেলিম চৌধুরীর পথসভায় আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা সে হুমকি দিয়েছিলো বলে লোকজন জানান। এই আশঙ্কা থেকে মোটর সাইকেলে প্রতীকের হাজার হাজার সমর্থক ভোটকেন্দ্রের অদূরে অবস্থান নেন। যদি ভোটে কোনো ধরণের অনিয়ম হলে বড় ধরণের অঘটন ঘটবো বলে আশঙ্কা ছিলো লোকজনের।
ভোটের চিত্র পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে তারেক শরীফের পক্ষে ভোটারদের শ্লোগান দিতে দেখা গেছে। এমনটি এখলাসুর রহমানের নিকটস্থ একটি কেন্দ্রেও তারেকের পক্ষে শ্লোগান দিতে দেখেছে এই প্রতিবেদক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক বির্তকিত কর্মকান্ড থাকলেও কালারমারছড়ার মানুষের আস্থায় পরিণত হয়েছেন তারেক বিন ওসমান শরীফ। অন্যদিকে ভোটের আগের রাতে তারেকের আটককে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেছেন সাধারণ ভোটাররা। এতে অনেকে ভোটার মত পরিবর্তন করেছেন। তাই দলমত ও প্রতীক ভোলে তারেকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে অধিকাংশ মানুষ। তাই তারা দু’হাত ভরে তারেকের বাক্সে ভরে দিয়েছেন ভোট।
বিজয়ের প্রতিক্রিয়ায় তারেক বিন ওসমান শরীফ বলেন, প্রবল আশঙ্কা সত্ত্বেও প্রশাসন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিয়েছেন। এতে আমি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। এই আমি প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই। পাশাপাশি আমার জণগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। এবার টার্গেট একটি সন্ত্রাসমুক্ত কালারমারছড়া উপহার দেয়ার। এই জন্য আমি সকলের সহযোগিতা কামন করছি।’
নিনির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গতকাল দেশের ৬০ ইউনিয়নের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে একমাত্র কালারমারছড়াকে বিশেষ বিবেচনায় রাখা হয়। সে কারণে তিন স্তরের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে কালারমারছড়ার নির্বাচনে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরাজুল হক টুটুল বলেন, ভোট গ্রহণের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় হয়েছে। প্রতিটি ভোটারের জন্য আলাদা আলাদা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। এছাড়াও পুরো পরিস্থিতি সামলাতে তিন স্তরের নিরাপত্তা নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এতে দায়িত্ব পালন করেছে চারজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, একজন জুড়িসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, তিন প্লাটুন র‌্যাব, দুই প্লাটুন বিজিবি, দুই প্লাটুন কোস্টগার্ড।