বাংলাট্রিবিউন:

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ভাঙার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তারা জোট থেকে খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে বের করে নতুন জোট গঠনের চেষ্টা করছে। রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। একইসঙ্গে বিএনপি ঘেঁষা কয়েকটি ইসলামি দলের কয়েকজন আলেম গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে বলেও জানা গেছে।

টার্গেট খেলাফত মজলিস ও জমিয়ত!
১৭ বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ রয়েছে ইসলামী ঐক্যজোট। সেই জোট থেকেই খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে বের করার চেষ্টায় আছে সরকারি দল। আগামী নির্বাচনে কওমিপন্থী দলগুলোকে দিয়ে পৃথক একটি জোট করার ব্যাপারেও আগ্রহী সরকার। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোরও নীরব সম্মতি আছে। তবে নির্বাচনি সমঝোতা নিশ্চিত করেই পরবর্তী পদক্ষেপ নিত চায় দলগুলো। যেসব আসনে তারা প্রার্থী দেবে সেখানে আওয়ামী লীগ কোনও প্রার্থী দেবে না এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে চায়।

এ লক্ষ্য পূরণ করতে দুটি পক্ষকে কাজে লাগাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। একটি হচ্ছে, ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করা ইসলামী ঐক্যজোট। অন্য পক্ষ হলো, রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের দিয়েই খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের অংশগ্রহণে নতুন জোট করার বিষয়টি নিশ্চিত করা।

সূত্রের দাবি, ইসলামী দল দুটিকে বিএনপি থেকে বের করে আনতে ইসলামী ঐক্যজোটের দুই প্রভাবশালী নেতা কাজ করতে বেশ আগ্রহী। এমনকি এ নিয়ে এই দুই নেতা সরকারের প্রভাবশালী একজন কর্মকর্তার সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ করছেন। নিচ্ছেন বিভিন্ন প্রণোদনাও।

এ বিষয়টি ‘মিথ্যাচার’ বলে দাবি করেছেন ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকার কেন ইসলামী ঐক্যজোট করার কথা বলবে? দীর্ঘদিন ধরেই আমরাই চেষ্টা করছি ইলেকশন অ্যালায়েন্স করতে। খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে নিয়ে একটি জোট করতে চাই আমরা।’

তবে বিএনপি জোট ছাড়ার কোনও ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন জোট শরিক খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এগুলো একটি মহলের বানোয়াট কথা। জোট ছাড়ার এখনই কোনও চিন্তা নেই।’

২০ দলীয় জোটের একটি অসমর্থিত সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি জমিয়তের মহাসচিব মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমি তাদের ‘ঠিকঠাক’ মূল্যায়ন করতে বিএনপির দায়িত্বশীল পক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন। জোটের প্রতিষ্ঠাকালীন শরিক হলেও প্রাপ্ত মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ আছে জমিয়তের।

তবে দলটির নির্বাহী সভাপতি মুফতি ওয়াক্কাছ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এ ধরনের তথ্য তার জানা নেই।

তিনি বলেন, ‘জোট ভেঙে আসা কী এত সোজা? রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনেক কঠিন। সময়ই বলে দেবে কী হবে। তবে আমরা মাথা বিক্রি করবো না। বিএনপির কাছেও না, আওয়ামী লীগের কাছেও না।’

গোয়েন্দা সূত্রটির দাবি, কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের মাস্টার্স সমমান স্বীকৃতি দেওয়ার পরই গোটা কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে সরকার। ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচনেও ইসলামি দলগুলো সরকারের ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রত্যাশা করছেন গোয়েন্দারা।

জানা গেছে, বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোর প্রবীণ নেতাদের নির্বাচনি আসন, এলাকার পরিস্থিতি, ভোটারদের মনোভাব বুঝতে মাঠে নামছে এই গোয়েন্দা সংস্থা।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের তখনকার চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চারদলীয় জোট কলেবরে বেড়ে ১৮ দলীয় হয়। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) বেরিয়ে গেলে ভাঙন ধরে জোটে। আর গত বছরের ৭ জানুয়ারি বেরিয়ে যায় ঐক্যজোট।

বিএনপি নেতারা বরাবরই অভিযোগ করেছেন, তাদের দলে ভাঙন ধরাতে চায় সরকার। এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এ ধরনের খবর পাইনি। তবে সরকার তো প্রতিনিয়তই আমাদের জোট ভাঙতে চায়। এর উদ্দেশ্য একটাই- ক্ষমতায় টিকে থাকা, ক্ষমতাকে ধরে রাখা। তা যেভাবেই হোক। আর বিরোধীদলকে দমিয়ে রাখা।’

এদিকে, বিএনপি-ঘেঁষা কয়েকজন আলেম গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে আছেন বলে জানা গেছে। কওমি মাদ্রাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতিকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের কয়েকজন নেতার মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে-এমন খবর পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের আশঙ্কা, এই অংশটি আল্লামা শফীকে আবারও বিভ্রান্ত করতে পারে। এ কারণে অন্তত ১০ নেতাকে নজরদারিতে আনা হয়েছে।

যদিও এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন হেফাজতের দায়িত্বশীল এবং ইসলামী ঐক্যজোট ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রভাবশালী দুই নেতা। তারা মনে করেন, হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতিতে খুশি।

আলেমরা বলছেন, ‘কওমি স্বীকৃতি ইস্যুতে সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ পাবে। এক্ষেত্রে জনমত কিছুটাও হলেও সরকারের দিকে হেলেছে।’

মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, ‘জনমত পরিবর্তন হবেই। সবসময় জনমত স্থির থাকে না। প্রয়োজন সাপেক্ষে জনমত পরিবর্তন স্বাভাবিক।’

একই সুরে মুফতি ওয়াক্কাছ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই। আহমদ শফী সাহেবকে সম্মান করে আমাদের দাবি অনুযায়ী স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।’

তরুণ আলেমরাও সরকারের এ সিদ্ধান্তে বেশ খুশি জানিয়ে মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের মাস্টার্স সমমান দেওয়ার কারণে সাধারণ তরুণ আলেমদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছে।’