জালাল উদ্দিন :

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল শতাব্দির সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়।এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল অত্র অঞ্চলের মানুষ।

তাদের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছিল।এতে প্রায় ৩০ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছিল।বাস্তু ভিটে-সহায়সম্বল হারিয়ে উদ্ধাস্তু হয়েছিল প্রায় দুই লক্ষ মানুষ।

তখন আমার বয়স মাত্র ১১/১২ বছর।স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র আমি।সেই দিন সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল।কিন্তু বাতাসের গতি বেগ ছিল টান।বাতাসের গতিবেগ ক্রমান্বয়ে বাড়তেছিল।

স্কুলে যাওয়ার পথে বাজারে ও দোকানে অনেক গুলো লোক জড়ো হয়ে রেড়িও শুনতেছিল।বিদ্যালয়ে গিয়ে স্যারের কাছ থেকে জানলাম,আজ নাকি ৯ নং মহাবিপদ সংকেত আছে।

তাই বিদ্যালয় ১ ঘন্টা পর ছুটি হবে।তবে বিপদ সংকেত কি তা বুঝার বয়স তখনও আমার হয়নি ;তবে এটুকুই বুঝলাম আজ তুফান হবে, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়ায় কম্বলমুড়ি দিয়ে ঘুমাতে বেশ আরাম লাগবে। বৃষ্টির দিনে আর ও আনন্দের বিষয় থাকত, বিদ্যালয় তাড়াতাড়ি ছুটি হলে স্কুল ড্রেস ও বই খাতা পলতিনের ব্যাগে শক্ত করে বেঁধে বৃষ্টিতে ভিজে সদলবলে বাড়ির উদ্দেশ্যে দৌঁড়ানো।

সে দিনও এর ব্যাতিক্রম ঘটল না। বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি এসে দেখি আমাদের বাড়িতে সমুদ্রতীরবর্তী কয়েকটি পরিবার এসে আশ্রয় গ্রহণ করছে।তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম সমুদ্র খুবই উত্তাল।

যে কোন সময় বেড়িবাধ প্লাবিত হতে পারে।আমার সমবয়সী আমার এক মামাত ভাই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল।সে ও আমি মায়ে দেওয়া বিন্নি চাওলের কড়ই খেলাম।এদিকে বাতাসে তীব্রতা ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্কর হচ্ছিল।

বাসাত প্রথমে উত্তর- দক্ষিণ কোণা থেকে আরম্ভ হলেও ক্রমান্বয়ে তা ঘড়ির কাটার দিকে ঘুরতেছিল।এভাবে তা রাত৯/১০টার দিকে দক্ষিণ -পশ্চিম কোণা থেকে বাতাস বয়তে শুরু করল।বাতাসের তীব্রতা ছিল ঘন্টায় ১৮০-২০০ কিঃমিঃ।তখন মানুষের ঘরের চাল উড়ে আসতেছিল।

সশব্দে ভেঙ্গে পড়ছিল বড় বড় গাছ-পালা।তখন আমাদের রান্না ঘরের চালটা যখন উড়ে যেতে চাচ্ছিল তখন চালে রশি বেঁধে ৬/৭ জন যুবা লোক তা আটকে রাখার চেষ্টা করছিল।কিন্তু আমরা ছোটরা বিশেষ করে আমি এবং আমার মামাত ভাই আমাদের বারান্দার খাটিয়ার উপর কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিলাম।

রাত যখন প্রায় ১২ টা তখন মা আমাকে নাম ধরে ডাকলেন,আর বললেন,” উঠ! পানি এসেছে।” আমি তো ঘুমের ঘোরে অনেকটা বিশ্বাস করতে পারিনী।কিন্তু খাট থেকে নেমে দেখি,আমাদের বাড়ির ভেতর হাটুজল।তখন চারি দিকে কান্নার রোল আর প্রাণ বাঁচতে আতঙ্কিত মানুষের ছুটোছুটি দেখে আমি সত্যিই আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম।আর সবার সাথে দৌঁড়ে মাটির বাড়ির ছাদে( ডুবালায়) উঠলাম।

কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমার মায়ার ডাক শোনে আমি নিচে নেমে আসি।মা বলল,” মাটির দেওয়াল ভাঙ্গলে বাঁচা মুশকিল হবে,চল বাহিরে নারিকেল গাছের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়ায়।” মায়ের সাথে গেলাম ঘরের বাইরে।কিন্তু পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে, আমি প্রায় ডুবে যাচ্ছিলাম।তখন মা আমাকে নারকেল গাছে তুলে দিল।তিনি নারিকেল গাছটি আগলে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

রাত প্রায় ১:৩০টা-২:০০টার দিকে পানি কমতে শুরু করে। ৪:০০টার দিকে পানি সম্পূর্ণ নেমে যায়।সকালের দিকে দেখি অনেকের বাড়িতে কান্নার রোল। কারণ,তাদের আপন জন পানিতে ভেসে গেছে।খালে বিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় অনেক মৃত মানুষ।হাঁস,মুরগী,গরু ছাগল তো আছেই। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী দেখা দিল প্রবল খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সংকট।

তখন আমরা পুরো ১ দিন ভেসে আসা নারিকেল ও ডাবের পানি এবং ডাবের চুবড়া খেয়ে জীবন রক্ষা করেছিলাম।প্রায় ২৪/৪৮ ঘন্টা পর হেলিকপ্টার এসে রুটি ফেললে তা খেয়ে আমরা জীবন রক্ষা করেছিলা। এ দিনটির কথা মনে পড়লে এখনও শিউরে উঠি।ভাবি একটু সতর্ক হলে হয় তো এত প্রাণহানি হতো না।

পরিশেষে, এদিনে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের বিদেহী আত্নার মাগফিরাত কামনা করছি।আর উপকূলবাসিকে সতর্কতাপূর্ণ জীবন যাপন করার আহবান করছি।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, সাইরার ডেইল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়।
মাতারবাড়ী, মহেশখালী, কক্সবাজার।
মোবাইল : ০১৮১৬-৩৫৮৫৪৫