বিশেষ প্রতিবেদক:
উখিয়ায় ১৩ বছর বয়সী পঞ্চম শ্রেনীর শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় একমাত্র আসামী আজিজুল ইসলামকে গ্রেফতারের কোন উদ্যোগ নেই পুলিশের। গত তিন দিনেও পুলিশ আসামীকে গ্রেফতার করতে পারেনি। উল্টো গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে ধর্ষণের শিকার শিশুটিকে। মামলার বাদী শিশুটির পালক মাও রয়েছেন সাথে। সেখানে কৌশলে মামলাটি সমঝোতার চাপ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গতকাল রাতে আসামীর ছেলে-মেয়ে, আত্ত্বীয়-স্বজন এবং এলাকার জনপ্রতিনিধিরা মিলে মামলার বাদিকে প্রলোভন ও চাপ প্রয়োগ করে ঘটনাটি সমঝোতার চেষ্টা চালান। মামলার বাদি তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘আসামীর ছেলে-মেয়ে, আত্ত্বীয়-স্বজন ও এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বাররা থানায় এসে আমাকে মামলা প্রত্যাহারের চাপ দিচ্ছে। তারা আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকিও দিচ্ছে। এই মামলায় আমাকে ফাঁসিয়ে দেয়া হবে বলেও হুমকি দিচ্ছে। এমনকি আমাকে সংসার ও ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে মামলা প্রত্যাহারের চাপ দেয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় আমি অসহায় হয়ে পড়েছি।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আবুল খায়ের বলেন, ‘আমরাতো সমঝোতা করতে পারিনা। সমঝোতা করার আমাদের দরকারও নেই। আসামী হলো মামলার বাদীর স্বামী। তারা নিজেরা ঝগড়াঝাড়ি দিয়ে নিজেদের সংসার ও ছেলে-মেয়ের জীবন ধ্বংস করলে আমার কি? কালকেই ভিকটিমকে আদালতে হাজির করবো।’ চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নিয়ে সমঝোতার চাপ দেয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান-মেম্বাররা এসেছিল অন্য একটি মারামারির ঘটনা নিয়ে।’ মোবাইল বন্ধ পাওয়ায় চেয়ারম্যান নুরুল আমিনের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড: এ.কে.এম ইকবাল হোসেন গতকাল রাতে সকালের কক্সবাজারকে বলেন, ‘উখিয়ার ১৩ বছর বয়সী ভিকটিমের বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছি। ভিকটিমের যাতে কোন ধরনের সমস্যা না হয় সে ব্যাপারে আমি উখিয়া থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছি। এছাড়া ভিকটিমকে কোথায় রাখা হবে তা আদালতই সিদ্ধান্ত নিবে।’
এদিকে গতকাল বিকালে ধর্ষনের শিকার শিশু ও শিশুটির পালক মা এবং মামলার বাদী তাহমিনাকে উখিয়া থানায় নেয়া হলে সেখানে জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা নুরুল আমিন সহ আসামীর আত্ত্বীয়-স্বজনরা ভিড় জমান। তারা সেখানে উখিয়া থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন। সেখানে মামলার বাদীকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য কৌশলে চাপ প্রয়োগ করেন। মামলার বাদীকে তার সংসার ও ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া ধর্ষণের শিকার শিশুটিকে সেখানে হাতে-পায়ে ধরে রাজি করানোরও চেষ্টা চলে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এর আগে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করে এমন সংগঠন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো শিশুটিকে পুলিশ হেফাজতে না নিয়ে ‘সেইফ হোম’ এ রাখা অথবা আদালতে সোপর্দ করে আদালতের সিন্ধান্ত নিয়ে শিশুটিকে হেফাজতে রাখার দাবী করেছিল। কিন্তু পুলিশ শিশুটিকে আদালতে না নিয়ে উখিয়া থানায় নিজেদের হেফাজতে নেয়। আর এ অবস্থায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংগঠনগুলো।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র লিগ্যাল অফিসার অ্যাডভোকেট শাজ্জাতুন্নেছা লিপি বলেন, ‘ভিকটিমকে আমাদের সেইফ হোমে রাখার জন্য আমি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের এখানে রাখেননি। প্রায় সময়তো বিভিন্ন থানা থেকে ভিকটিমদের আমাদের এখানে রাখা হয়। আর তারা না রাখলে আমাদের তেমন কিছু করার নেই। আইন মেনে পুলিশ নিজেদের হেফাজতে রাখতে পারলে আমরা কিইবা করতে পারি। তবে এ বিষয়ে আমরা সহ বেশ কয়েকটি সংস্থা নজর রাখছে।’
ধর্ষণের শিকার শিশুটির আইনি ও চিকিৎসা সহায়তায় গতকাল বিকালে নারী ও শিশু সুরক্ষা নেটওয়ার্কের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন সহ-সভাপতি ও নারী নেত্রী কবি শামীম আক্তার, সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবদুশ শুক্কুর, সাংবাদিক রাশেদুল মজিদ প্রমুখ। এতে ধর্ষনের শিকার শিশুটির চিকিৎসা ও আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি দাবী রেখে বলা হয়- বর্তমানে মানসিকভাবে বিপর্যস্থ শিশুটি যাতে শিশু অধিকার আইনের আলোকে শিশু সুলভ আচরণ পায়, জবানবন্দি আদায়ে অধিকতর সর্তক থাকা, শিশুটি যাতে ভীত না হয় এবং যথাযথ আইনি সহায়তা যাতে শিশুটি পায় সে দিকে দৃষ্টি দিতে প্রশাসনের প্রতি জোর দাবী জানানো হয়। একই সাথে ধর্ষককে দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে শাস্তির দাবী জানানো হয়েছে। এছাড়া ধর্ষক আজিজকে দ্রুত গ্রেফতার করে শাস্তি প্রদান ও ভিকটিমকে আদালতের নির্দেশে সরকারি বা বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় রেখে চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা দানের দাবী জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারস ফোরাম নামের একটি সংগঠন। সংগঠনটির কক্সবাজার জেলা আহবায়ক অ্যাডভোকেট অরূপ বড়–য়া তপু, যুগ্ন আহবায়ক অ্যাডভোকেট আবদুশ শুক্কুর ও সদস্য সচিব মিজানুর রহমান বাহাদুর এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন-ভিকটিম শিশুটির নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও ন্যায় বিচার প্রাপ্তির স্বার্থে অভিযুক্ত আজিজুল ইসলামকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা অত্যান্ত জরুরী। একই সাথে ভিকটিমের ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে যে কোন ধরণের অপকর্ম ও ষড়যন্ত্র বন্ধে জেলার সকল সচেতন নাগরিক ও সংগঠনকে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানানো হয়। হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারস ফোরাম এর সদস্য সচিব মিজানুর রহমান বাহাদুর বলেন, ‘শিশুটির ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে প্রয়োজনে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামেরও ডাক দেয়া হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার ইনানী মোহাম্মদ শফির বিল এলাকার মৃত মোহাম্মদ কালুর পুত্র আজিজুল ইসলাম তাঁর ১৩ বছর বয়সী পালক মেয়ে সন্তানকে ধর্ষন করেন। ধর্ষনের পর রক্তক্ষরণ শুরু হলে তাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে চিকিৎসা নিতে দেয়া হয়নি। আজিজ নিজেই ওষুধ নিয়ে মেয়েটিকে খেতে বাধ্য করতো। এমনকি দীর্ঘদিন ধরে তাকে বিভিন্ন কৌশলে ঘরে আটকে রাখা হয়। মেয়েটির অবস্থা বেগতিক দেখে আজিজের স্ত্রী তাহমিনা শিশুটিকে ১২ এপ্রিল কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ খাইরুন্নেছা মুন্নীকে দেখান। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৩ এপ্রিল কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে গত ১৭ এপ্রিল বেসরকারি সংস্থা নারী ও শিশু সুরক্ষা নেটওয়ার্কের সহায়তায় শিশুটিকে ওয়ান ষ্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। ১৮ এপ্রিল ধর্ষক আজিজের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন শিশুটির পালক মা তাহমিনা আক্তার।