ইমাম খাইর, সিবিএন:
কক্সবাজার সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টের প্রায় দেড় শতকোটি টাকার সরকারি জমি দখলে রাতারাতি মাটি ভরাট কাজ বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। বৃহস্পতিবার বিকালে জেলা প্রশাসনের একটি টীম ঘটনাস্থলে যান। সেখানে সরকারী খাস জমি চিহ্নিত করে কাঁটা তারের বেড়া ও সতর্কিকরণ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয়েছে- ‘ইহা সরকারী খাস জমি। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যাতিত এখানে প্রবেশ নিষেধ। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ এ সময় ভেঙে দেয়া হয়েছে সেখানকার কয়েকটি ছোটখাট অবৈধ স্থাপনা।
অভিযানকালে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আনোয়ারুল নাসের, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার (সদর) পঙ্কজ বড়ুয়াসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ সময় উপস্থিত প্রশাসনের কর্মকর্তারা আগামী রবিবার থেকে সুগন্ধা পয়েন্টে অবৈধ দখল উচ্ছেদে অভিযান চালানো হবে বলে জানান। একই সঙ্গে সরকারী খাস জমি দখলকারীদের সতর্ক করা হয়। এরপর পার্শ্ববর্তী মারমেইড ইকো-রিসোর্টের দখলে থাকা সরকারী জমিতে সতর্কতা সংকেত সম্বলিত সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। সেখানেও সহসাই কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সরকারী জমি জবর দখলমুক্ত করার ঘোষণা দেন সংশ্লিষ্টরা।
সুত্র জানিয়েছে, সুগন্ধা পয়েন্টের শত কোটি টাকার সরকারী জমি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে ২০ জনের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটে রাজনৈতিক দলের নেতা, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, জমির দালাল, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছে। তারা জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেনের অনুপস্থিতিতে দখল নিশ্চিত করতে চায়। এ কারণে রাতারাতি তারা মাটি ভরাটের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সংশ্লিষ্ট একটি বিশ্বস্থ সূত্র এসব জানায়।
সূত্রটির দাবী, সাড়ে তিন একরের দেড়শ কোটি টাকা মূল্যের ওই জমি হাতিয়ে নিতে গত ৫/৬ বছর আগে আবদুল আওয়াল মিঠু ও রাসেল নামের দুই ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি চক্র মাঠে নামে। নেপথ্যে রয়েছে আরো ৬/৭ জন রাঘববোয়াল। সিন্ডিকেটে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা দখলবাজের নামও আলোচনায় ওঠে আসছে।

অবৈধ মাটি ভরাট কাজ পরিদর্শন করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আনোয়ারুল নাসের, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার (সদর) পঙ্কজ বড়ুয়াসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

দখলবাজরা প্রথমে সূগন্ধা সড়কের পাশে ভাসমান ও ঝুপড়ি দোকান নির্মাণ করে। এরপর সড়কের পেছনে সরকারি জমি ভরাট করে দোকান ও ঘর নির্মানে নামে। এখানকার অবৈধ স্থাপনাসমূহ এর আগেও বেশ কয়েকবার উচ্ছেদ করা হয়।
অভিযোগ এসেছে, প্রশাসনের উচ্ছেদ অভিযান থেকে রক্ষা পেতে প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করে দখলবাজরা কৌশলে আদালতে ‘রিট আছে’ উল্লেখ করে কখনো কখনো পার পেয়ে যায়। আর এভাবেই অবৈধ দখলদাররা ৫/৬ বছর ধরে কোন কাগজপত্র ছাড়াই সেখানে দখল কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।
গত ৫/৬ বছরে বিভিন্ন জনকে ওই জমি দেয়ার লোভ দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। দোকান দেয়ার লোভ দেখিয়েও নেয়া হয় টাকা। সময়ের ব্যবধানে চক্রটিতে জড়িয়ে পড়ে নতুন নতুন সদস্য। প্রশাসনিক, আর্থিক ও স্থানীয় প্রভাবের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বর্তমানে প্রায় ২০ জনের একটি সিন্ডিকেট তৈরী করা হয়েছে।
সিন্ডিকেটটিতে চুক্তি অনুযায়ী জমি ও দোকান বরাদ্দ দেয়ার শর্তে সিন্ডিকেট সদস্যরা কাজ চালাচ্ছেন। অনেকে দিচ্ছেন টাকা, কেউ স্থানীয় প্রভাব, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যায়ের কয়েকজন দিচ্ছেন প্রশাসনিক সুবিধা। রাজনৈতিক দলের নেতারা দলীয় প্রভাব কাজে লাগিয়ে প্রশাসন ও স্থানীয় পর্যায়ে ভূমিকা রাখছেন। আবার সংবাদ মাধ্যম ম্যানেজ করতে এক সাংবাদিককেও সিন্ডিকেটে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, জমি দখলের ঘটনায় জড়িত প্রশাসনের অভ্যন্তরে থাকা চক্রটি জমির বিষয়ে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভুল ধারণা দিচ্ছেন। এভাবে প্রশাসনের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিভ্রান্ত করে জমিটি হাতিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে চলেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কলাতলীর হোটেল-মোটেল জোন এলাকার বিএস-১ নং খতিয়ানের ১৩০ একর জমির মধ্যে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর ৮৭টি প্লটের বিপরীতে ৮৬.৩১ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়। আর ওই বরাদ্দের মধ্যে ঢাকার মরহুম ইউনুছ আলী খানের পুত্র ফরিদুর রহমান খান এক একর ৬৩ শতক এবং মরহুম এম.এ রশিদের পুত্র আক্তার মাহমুদ রানার নামে দুই একর জমি নিয়ে হোটেল-মোটেল জোন এলাকায় ২৮/এ, ২০/এ, ২৮/বি ও ২০/বি নামে সরকারের পক্ষ থেকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু ২০১০ সালে সরকার এসব প্লটের বরাদ্দ বাতিল করে লাল পতাকা দিয়ে এসব জমি নিজেদের আয়ত্তে নেয়। পরে লীজ গ্রহিতারা উচ্চ আদালতে রিট করলে স্থিতাবস্থা জারির নির্দেশ দেন আদালত। বর্তমানে সরকার ও লীজ গ্রহিতার মধ্যে জমির মালিকানা নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় তৃতীয় একটি ভূমিগ্রাসী চক্র প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাত করে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা মূল্যের এ জমি হাতিয়ে নিতে তৎপরতা শুরু করেছে।
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আনোয়ারুল নাসের জানান, সরকারী জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ কোন মতেই মেনে নেয়া যায়না। দখলকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। রবিবার থেকে উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো হবে। কারো ছাড় নাই।
একটি সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন দখলবাজদের প্রশ্রয় দেননা। অনেক সময় রাজনৈতিক দলের নেতাসহ প্রভাবশালীদের তদবীরও ফিরিয়ে দেন। জেলা প্রশাসক ১০ দিনের সফরে অষ্ট্রেলিয়া রয়েছেন। এ সুযোগে দখলবাজরা দ্রুত সময়ে দখল নিশ্চিত করতে পাগলপ্রাণ হয়ে গেছে।