সংবাদ বিজ্ঞপ্তি:
কক্সবাজারের ঈর্ষনীয় জনপ্রিয় এক নেতার নাম এড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামন। তিনি ছিলেন কক্সবাজার-রামুর দুইবারের সাবেক এমপি। আজ তাঁর ২০ তম শাহাদাত বার্ষিকী।

২০০১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রামুর বাইপাস চত্তরে হাজার হাজার মানুষের এক নির্বাচনী জনসভায় তিনি ইন্তেকাল করেছিলেন।
তাঁর ইন্তেকালের ২০ তম বর্ষেও রামু-কক্সবাজারের মানুষ তাঁকে যেভাবে স্মরণ করছেন এতে করে মনে হচ্ছে জনগণের ভালবাসা সিক্ত এড. খালেকুজ্জামান আজো বেচেঁ আছেন তাদের মাঝে।

২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচন পর্যন্ত বেঁচে থাকলে হয়ত ৩য় বারের মত কক্সবাজার সদর-রামুর এমপি হতেন তিনি।

ইন্তেকালের ২০ বছর পরে আজো রামু-কক্সবাজারের জনগণ শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করছেন তাদের প্রিয় মানুষ মরহুম এড.
খালেকুজ্জামানকে। নানা আয়োজনের মাধ্যমে স্মরণ করা হচ্ছে তাঁকে।

রামু-কক্সবাজারের বিভিন্ন মসজিদে হচ্ছে তাঁর জন্য দোয়া মাহফিল। স্থানীয় সংবাদ পত্রগুলো প্রকাশ করছে তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিদগ্ধ লেখকদের তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।

খতমে কোরআন, এতিম খানায় ভাল খাবার সরবরাহ ও দোয়া মাহফিলে স্মরণ করা হচ্ছে প্রিয় নেতা খালেকুজ্জামানকে।

এড. খালেকুজ্জামানের বর্ণাঢ্য জীবনী

মোঃ খালেকুজ্জামান ১৬ জানুয়ারী ১৯৫৩ ইংরেজী মৌলবী ফরিদ আহমদ ও বেগম রিজিয়া আহমদের ঐরসে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা মরহুম মৌলবী ফরিদ আহমদ ছিলেন সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য ও ১৯৫৭ সালে গঠিত আইআই চুন্দ্রীগড় মন্ত্রীসভার কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রী।

২০০১ সালের ১লা অক্টোবরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র তিনদিন আগে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০১ রামু বাইপাসের বর্তমান‘খালেকুজ্জামন চত্বরে লাখো মানুষের জনসভায় হেসে হেসেই তিনি দুনিয়া থেকে চলে যান। তখন তিনি ছিলেন, তৎকালীন ৪ দলীয় জোটের কক্সবাজার-রামুর আসনেরমনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী।

প্রচার বিমুখ এড খালেকুজ্জামান

ছিলেন অত্যন্ত ধীশক্তির অধিকারী। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁর মেধার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর রেখে গেছেন তিনি। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের Institute of Business Administration থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে পাশ করেন MBA, IUBAT এর একজন সফল শিক্ষক হিসেবে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের শ্রদ্ধা ও প্রশংসা অর্জন করেছেন। LLBপরীক্ষাতেও তিনি তাঁর প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।

১৯৯৬ সালে কক্সবাজার-রামু আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি সাড়া জাগিয়েছিলেন পার্লামেন্টে। স্থানীয় স্কুল,কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদের উন্নয়নে রেখে গেছেন এক অবনদ্য অবদান। রামু কলেজ,কক্সবাজার সিটি কলেজ ও ঈদগাঁও রশীদ আহমদ কলেজ, রামু হাই স্কুল,নাদেরুজ্জামান হাইস্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উন্নয়নে তিনি পালন করেছেন প্রশংসনীয় ভূমিকা।

কম্পিউটার বিজ্ঞান শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য তিনি প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন কর্তৃপক্ষকে। আর তাঁর সে মহতী উদ্যোগের সুফল ভোগ করছেন এলাকাবাসী। আজ বেশ কিছু স্কুল-কলেজে কম্পিউটার বিজ্ঞান শিক্ষা কোর্স চালু করা হয়েছে।

তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত মেধাবী ও সফল কম্পিউটার বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে কম্পিউটার শিক্ষার বিস্তার তথা কম্পিউটার এর ব্যাপক ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অবকাঠামো সৃষ্টিতেও তাঁর ছিল প্রবল আকাঙ্খা। একজন খ্যাতিমান আইনজীবী পেশাগত জীবনে বিনা পারিশ্রমিকে তিনি অনেক অসহায় মানুষের মামলা পরিচালনা করে তাদেরকে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করে গেছেন।

সদালাপী, নিরহংকার, সহজ সরল এক দুর্লভ ব্যক্তিত্ব ছিলেন খালেকুজ্জামান। মানুষকে সহজে আপন করে নেবার এক সহজাত ক্ষমতা ছিলো তাঁর।

অদেখা চোখে মরহুম জননেতা খালেকুজ্জামান
।। ইমরান হাসান জেসন।।

২০১১’ অগাষ্ট কিংবা সেপ্টেম্বর’এর কোন এক জুম’আ বার হবে খুব সম্ভব। বাবাকে সমাহিত করার পর ফিরে এসে প্রথমবারের মতন কক্সবাজার গেছি। গোলদিঘীর পার সংলগ্ন মসজিদে জুম’আর সালাত আদায় করে পাশেই অবস্থিত কবরস্তানে বাবার কবর জিয়ারত করতে যাবো। মসজিদের গেটে’এ অপেক্ষা করছি চাচার জন্য। হঠাৎ গেট’এ মাথা গলিয়ে বাইরে আসা হালকা গড়নের অভিজাত চেহারার একজন খুব আকর্ষন করলো আমায়। মাঝারি উচ্চতার পায়জামা-পাঞ্জাবী পরিহিত, এক প্যাঁচে শাল জড়ানো অনেকটা নজরুলের মতন। দাড়িতে কি সুন্দর মানিয়েছে, ভারি হ্যান্ডসাম তো! বেরিয়েই আমার সাথে চোখাচোখি। হেসে আমায় বললেন ‘আইজ্জা রৈদ উডিবো’। কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম! চেনা নেই জানা নেই কেমন আপনজনের মতন অবলীলায় কথোপকথন! চাঁটগাইয়া আঞ্চলিক ভাষা বুঝি তবে বলতে কেমন সঙ্কোচ হয়। প্রচলিত টানে ঠিক বলাটা আমার হয়না। কয়েকবার বলার চেষ্টা করে লোকাল বন্ধুদের কাছে ‘ভৈঙ্গা’ ট্যাগ পেয়ে হাসির পাত্র হয়েছি। যে যাই বলুক অন্তত একজন চাঁটগাইয়া হিসেবে শ্লেষপূর্ণ টাইটেলখানি কিছুতেই সম্মানজনক নয় এটুক বুঝি। বিনীত হাসিতেই ভদ্রলোকের কথার প্রতি সায় জানালাম। উল্লেখ্য কয়েকদিন ধরে আবহাওয়া খুব বৈরি ছিলো এবং সুর্যের মুখ দেখা যাচ্ছিলো না। চাচা বের হলেন এবং আমরাও তড়িঘড়ি কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করলাম। জিয়ারত শেষে ফেরার পথে চাচা বললেন, চলো এমপি সহীদুজ্জামান সাহেবের সাথে দেখা করে আসি। শুনেছি তিনি কক্সবাজার এসেছেন। মূলত ‘সাবেক এমপি’ হবেন, তবুও তিনি আজীবনের এমপি সাহেব। মসজিদ ফেলে দু’চার কদম পরেই তার বাসভবন। ‘জামান ভিলা’। দরোজা খোলাই ছিলো। বৈঠকখানায় আমাদের বসিয়ে খবর দেয়া হলো। এমপি সাহেব এলেন এবং দ্বিতীয়বার ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম! এ যে মসজিদের বাইরে দেখা সেই হ্যান্ডসাম ব্যক্তিটি! এতো সুদর্শন এমপি’ও হয়! বাহ, দারুন তো! ভদ্রলোকের অমায়িক এবং বন্ধুবৎসল সাবলীল আলাপচারীতায় আবারও মুগ্ধ হয়েছি। আর চমকিত হয়েছি তার বিশুদ্ধ প্রমিত উচ্চারণে। তার বিশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে চট্টগ্রামের আঞ্চলিকতার টানের লেশমাত্র নেই! আমার পরিচয় পেয়েই পরম স্নেহে কাছে টেনে বসালেন। সদ্য পিতৃবিয়োগের শোক প্রকাশ করলেন, শান্তনা দিলেন এবং ফোন নাম্বার দিয়ে যোগাযোগ রাখার বারবার তাগাদা দিলেন। এত ভালো লাগলো, এত ভালো লাগলো ভদ্রলোকের বিনয়োচিত ব্যবহার যে বাসায় ফিরে অনিঃশেষ মুগ্ধতায় দাদীকে খুব বললাম তার কথা। শুনে দাদীর খুব সহজ সরল অনয়াস স্বদোক্তি, ‘ভাইয়র ডৈল্যা অইয়ে’!

দাদীর বলা ঐ ছোট্ট বাক্যটিই আমার আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য। এত লম্বা ভূমিকা টানার প্রয়োজনটি এখানেই। সেদিনের দাদীর সেই বাক্যটিতেই আমার যত উদ্দীপন মরহুম জননেতা খালেকুজ্জামানকে চেনার এবং জানার। কে সেই নেতা যার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার এতটা চিত্তকর্ষক, এতটা মনোগ্রাহী, এতটা আবেদনময়, এতটা খোলা হৃদয়ের! যার উত্তরাধিকার মনে এতটা রেখাপাত করে, তিনি তবে কি ছিলেন? কেমন ছিলেন?

যত জেনেছি, জানছি- বিমুগ্ধ হয়েছি, বিস্মিত হয়েছি, শিহরিত হয়েছি পরিশেষে তাঁর অকাল প্রয়ানে বেদনায় ক্লীষ্ট হয়েছি, শোকে মুহ্য হয়েছি। ভেতরের সহজাত অনুভূতি বলছে তিনি কতটা নক্ষত্রসম ছিলেন- নিখাদ ধ্রুবতারা। লুকোবো না, মানবিক স্বভাবজাত হীনমন্য সীমাবদ্ধতা থেকে ভারি ঈর্ষাকাতরও হয়েছি। যেই বয়েসে আমি টিএসসি’র মধুতে দু’একটা সালাম পাওয়া কিংবা ক্যাম্পাসের আড্ডার চেনা-পরিচিতিকে জীবনের পরম প্রাপ্তি ভেবেছি- সেই ত্রিশোর্ধ বয়েসে কেউ কি করে এত বিশাল জনগোষ্ঠির প্রিয় নেতায় পরিনত হয়? ধীরে ধীরে জননেতা এবং অবশেষে কিংবদন্তি! অবিশ্বাস্য‍! এ যেনো এক রূপকথা!

তার গৌরবময় শিক্ষাজীবন এবং বর্ণাঢ্য পেশাগত কৃতিই তো তাকে ঈর্ষা এবং সমীহ করার জন্য যথেষ্ঠ। ঢাকায় বেড়ে উঠা যৎসামান্য সার্টিফিকেটধারীরাও যেখানে ঢাকা ছাড়ার কথা কল্পনা করতে পারেন না সেখানে এমন ‘হাই প্রোফাইল’ ক্যারিয়ারের অধিকারী হয়েও কেবলমাত্র মাটির টানে তাঁর ঢাকা বিমুখতা রূপকথা নয় তো কি? কোথায় ক্যারিয়ার গড়বেন, গাড়ী-বাড়ী করবেন, বউ বাচ্চা নিয়ে ঢাকা-বিলেত-আম্রিকা-সিঙ্গাপুর ঘুরে বেড়াবেন, তা না, গিয়ে পড়লেন কোথায় কোন অনগ্রসর এক জনপদে মানবসেবার মানসে! কতটা কাঁদামাটি- সাদাসিধে, উদার আর বোকা বোকা স্বপ্নবাজ হলে কেউ এমনটা করতে পারেন!

আচ্ছা সে না হয় রাজনীতিতে এলেন, মিলিয়ে দেখা যাক তার সমসাময়িক কিংবা তাঁর বয়েসে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে চলনে-বলনে, মেধায়-মননে, কর্মে-প্রজ্ঞায়, বংশে-আভিজাত্যে কতটা মেলানো যায় তাঁকে? মেলে কি? আলোকবর্ষের ব্যবধান। কিংবা তারও বেশি। একজন আইবিএ গ্র্যাজুয়েট কি অবলীলায় বুকে বুক মিলিয়ে মিশে গেছেন জনস্রোতে, ভাবা যায়!

তিনি কোন লোক দেখানো রাজনীতি করেননি। শহীদ জিয়ার যোগ্য উত্তরসুরীর মতন হেঁটে বেড়িয়েছেন বিস্তীর্ণ প্রান্তর থেকে প্রান্তর। ধূলোয় ধুসরিত বদনে নিঃস্বার্থ জনসংযোগ করে বেড়িয়েছেন অক্লান্ত দিনের পর দিন। দুঃসময়ে যেমনি সকলের পাশে থেকেছেন তেমনি সুসময়ে সুখের মাছিদের কুকর্মে-অন্যায়ে দেননি কোনদিন নুন্যতম প্রশ্রয়। এই অনড় অদম্য দুর্নীতি বিরোধী মনোভাবের জন্য বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, রক্তাত্ত হয়েছেন, বুক চিতিয়ে সহকর্মীদের রক্ষা করেছেন তবু প্রতিশোধ নেয়া দুরে থাক কোনদিন একটা মামলাও করেননি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে! এ কেমন মানুষ! অথচ তাকে হত্যা করারও প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিলো কতবার! তিনি আমার ফুফুর বাসায় ভাড়া থাকতেন। ফুফুর কাছেই শুনেছি কয়েকবার তাকে হত্যার জন্য সশস্ত্র হামলা চালানো হয়েছিলো তার বাসায়। কেবল রাজনৈতিক বিরোধী দল নয়, জনশ্রুতি আছে নিজ দলের প্রতিপক্ষও এমনি মহতি উদ্যোগ নিয়েছিলো কতবার!! অথচ তিনি নিজে এমপি হয়েও বারবার তাদের ক্ষমা করেছেন, কাছে টেনে নিয়েছেন, করেছেন সঙ্গে পথ চলার অঙ্গীকার। নৈতিকতার মানদন্ডে তার এহেন উদারতার জন্য হয়তো তিনি স্মরিত এবং চর্চিত হবেন বারংবার তবে রাজনৈতিক চাতুর্যতার মাপকাঠিতে তিনি কতটা সঠিক তা ইতিহাস বিশ্লেষন করবে। যেমন আমার কাছে অন্তত এই বারংবার ক্ষমার প্রবনতা বড্ড বেশি ঔদার্য্য বলে মনে হয়েছে। হয়তো বা ভুলও। তার সেই উপেক্ষিত ক্ষতের যন্ত্রনায় কিন্তু তার উত্তরাধিকারদেরও ভূগতে হয়েছে। এমনকি সেই ক্ষমাপ্রাপ্ত ‘ওরা’ মরনোত্তর মরহুম খালেকুজ্জামান সাহেবকেও ছাড়েননি!! ক্ষমার ভাষা ক’জন বোঝেন? কুজন বোঝেন?

তবে তাঁর সেই অহিংস ভালোবাসার রাজনীতির ফল পেয়েছিলো কক্সবাজারের রাজনৈতিক অঙ্গন। সে সময়কার পরিবেশ আর আজকের পরিবেশ বিশ্লেষন করলে যে কেউই তা ক্ষনেই বুঝতে পারবেন। সে সময়ে একজন তরুণ রাজনৈতিক কর্মী স্বপ্ন দেখতো কি করে আদর্শিক চর্চা করে একজন খালেকুজ্জামান হওয়া যায় সেখানে আজকের কক্সবাজারের তরুণ সমাজ স্বপ্ন দেখে কি করে জমির দালালি কিংবা ইয়াবার ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতি হওয়া যায়! কিছুদিন আগে আমার এক নেতা বন্ধু আমায় সাক্ষাতের সময় দিলো সন্ধ্যায় হোটেল সায়মানের ‘বার’ এ! এ ছাড়া নাকি তার দেখা করার সময় নেই! এই হলো প্রিয় জন্মভূমি কক্সবাজারের আজকের রাজনৈতিক মাঠের হাল হাকিকত!!

হালের কথা বলতে গিয়ে মনটা তিতকুটে বিষন্ন হয়ে উঠলো বৈকি। কলম আর এগোচ্ছেনা। অকুতোভয় জননেতা খালেকুজ্জামানকে এই মুহুর্তে বড্ড বেশি ‘মিস’ করছি। ‘বাবা’-হাজীদের রাজত্বে কক্সবাজারে আজ আরেকটা খালেকুজ্জামানের খুব বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন সেই নেতাকে যিনি শুধু ফাঁকা বুলি নয়, যা বলেছেন অক্ষরে অক্ষরে তা দেখিয়ে গেছেন। কথা দিয়েছিলেন প্রয়োজনে জনতার জন্যে প্রাণ দেবেন। তিনি কথা রেখেছেন। চিকিৎসকের শত নিষেধ সত্বেও জনতার কাতারে গিয়েই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বলেছিলেন, ‘যেখানে আমার জন্যে সভায় লাখো মানুষ অপেক্ষা করছে সেখানে তাদের বঞ্চিত করে আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না!’ মুহুর্মুহু ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ আর ‘খালেক ভাই এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে’ শ্লোগানে প্রকম্পিত সভাস্থল। মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছেন নেতা মঞ্চের দিকে। একি! জনতার ভীড়ের মাঝেই হঠাৎ লুটিয়ে পড়লেন নেতা! জনতার নেতা জনতার মাঝেই বিলীন হয়ে গেলেন চিরতরে!

মৃত্যূও বুঝি এমন কাব্যিক হয়! অবিশ্বাস্য! অবিস্মরণীয়! রীতিমতন রোমাঞ্চিত শিহরিত হয়েছি এ দৃশ্য কল্পনা করে, যতবার ভেবেছি ততবারই গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেছে। অমন নায়কোচিত মৃত্যূ বুঝি হলিউডি ফিল্মকেও হার মানায়! জনতাও দিয়েছে তার এই আমৃত্যূ ভালোবাসার প্রতিদান উজাড় করে। গোটা কক্সবাজার শোকাচ্ছন্ন। আবালবৃদ্ধবনিতার অশ্রুজলে সিক্ত সমূদ্র কন্যা। উত্তাল জনতা। জনতার এক দাবী, নেতার উত্তরাধিকার চাই তারই পরিবার থেকে। কারণ জনতা প্রিয় নেতার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেতে চেয়েছিলো আপন কারো মাঝে। শ্লোগানে শ্লোগানে গোটা কক্সবাজার মুখরিত। হাতে হাতে কলাগাছ। সমূদ্রকন্যা যেনো আজ বিস্তির্ণ এক কলাবাগান! প্রিয় নেতার নামে কলাগাছকে মনোনয়ন দিলে জনতা সেই কলাগাছকেই নির্বাচিত করবে! সে এক অভাবণীয় পরিস্থিতি। কি দুর্বার জাদুকরি সম্মোহনি আকর্ষণ থাকলে জনতার অমন ভালোবাসা মেলে!
ধন্য হে নেতা।

তাঁকে নিয়ে বলার তো লোকের অভাব নেই। কত বিশ্লেষন, বিশেষণ আর স্মৃতির ফুলঝুরি। অদেখা আমার এই স্মৃতিকথনই ভরসা তাঁকে চেনার। সুক্ষভাবে বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রিয় নেতার আরও একটি ব্যপার আমাকে ভারি বিমোহিত করেছে। কে জানে, হয়তো টুকটাক লেখালেখির বদঅভ্যাস আছে বলেই। সে হলো তাঁর প্রাঞ্জল ভাষার দখল, শব্দচয়ন এবং সুক্ষ রসবোধ।
জাতীয় সংসদে তাঁর বলা ‘প্রেসিডেন্টের ভাষন বিমানবালার হাসির মতন’ কিংবা ‘এবারের বাজেট ছলনাময়ী সুন্দরী রমনীর মতো’ অথবা ‘চাঁদ দেখা কমিটির মত জাতীয় পানি দেখা কমিটি’ উক্তিসমূহ শুনে বোঝা যায় নিগুঢ় রসবোধসম্পন্ন কতটা সাহিত্যমনা ছিলেন তিনি। কথার ওজন বুঝতেও ওজন লাগে। আজকের সংসদের ক’জনা তার কথার নিহিত গুঢ় মানে বুঝবেন আমার সন্দেহ আছে।

কথায় কথা বাড়ে। কিছু কথা ফানুস হয়ে উড়ে যায় আবার কিছু চির দাগ কেটে যায় বুকে। এত এত ভালো কথার মাঝেও তেমনি দাগ কেটেছেন তার আদরের ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার সহীদুজ্জামানের ক’টা লাইন। তিনি তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন,
‘তিনি আমাকে প্রচন্ড আদর করতেন। আমার শরীরে বিভিন্ন জায়গায় তার চুমাগুলা আজও ভালোবাসায় স্মৃতি জাগানিয়া, আদর করে পুতু ডাকতেন। এমনকি জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরও জনসমক্ষে পুতু বলে তার অমলিন ভালোবাসার স্বীকৃতি দিতেন। এটুকু লিখতেই আমার চোখ অশ্রুসজল হয়ে গেছে।’

হাদীসে বর্ণীত হয়েছে, ‘সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম’।
মরহুম খালেকুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী তার স্মৃতিচারণে বলেছেন,
‘একজন আদর্শ পিতা হিসেবে বাচ্চাদের কাছে টেনে নিতেন আদর আর স্নেহ দিয়ে। জীবনসঙ্গী বা স্বামী হিসেবে ছিলেন হৃদয়বান। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেশ ও জনগনের জন্য দেখেছি সীমাহীন ভালোবাসা ও কর্তব্য পরায়নতা। বিশেষ করে গরীবদুখী মেহনতি মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করতেন সবসময়।’

আমার দেখা খুব কম স্ত্রীর’ই স্বামীকে নিয়ে অমন গর্ব করার সৌভাগ্য হয় এবং খুব কম স্ত্রী’ই স্বামীর প্রতি এতটা শ্রদ্ধাবোধ পোষন করেন। স্ত্রী’র সাক্ষ্য বলে দেয় তিনি একজন সফল প্রেমিক ছিলেন। সহধর্মিনীর মনজয়ী সুপুরুষ ছিলেন। আবারও তাঁকে ঈর্ষা। সত্যিই ঈর্ষা।

আর মা? কেমন ছিলেন মায়ের প্রিয় খালেক?

মা রেজিয়া বেগম তার স্মৃতিকথায় বলেছেন,
‘ওকে নিয়ে লিখতে গেলে যে অনেক লিখতে হবে। কিন্তু আমার যে ভীষন কষ্ট হচ্ছে। কলমটা চলছে না। তবুও কোনরকমে লিখছি। ছোটবেলায় থেকেই ওর প্রতি আমার অন্যরকম একটা দুর্বলতা ছিলো। ওরও আমার প্রতি প্রচন্ড দুর্বলতা ছিলো। আমার শরীর খারাপ হলে সেদিন আর স্কুলেও যেত না। আমার পাশে চুপ করে বসে থাকতো। মনটা খারাপ হয়ে যেত ওর। আমার সেই ছোট খালেক বড় হয়েও মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতো। সেই সন্তানকে হারিয়ে আমি এখন শোকে মুহ্যমান। আল্লাহ আমার সন্তানকে যেনো শ্রেষ্ঠ বেহেশত দান করেন। মায়ের প্রতিটি নিঃশ্বাসে সন্তানের জন্য দোয়া রইলো।’

এরপর কলম কি আর চলে? মা’রা কেবল ভাসেন না, ভাসাতেও জানেন।

গতবছরের শেষের দিকে মমতাময়ী মা তার আদরের খালেকের কাছে চলে গেছেন চিরতরে। আল্লাহপাক এই রত্নগর্ভা মহীয়সী মা ও তার আদরের খালেককে জান্নাতের সমস্ত নিয়ামত দিয়ে পরিপূর্ণ করে রাখুন।

প্রিয় নেতা, ঘুমাও তুমি মায়ের বুকে। অদেখা তোমায় না দেখার আফসোস আর হিংসে করেই না হয় এক জীবন কাটিয়ে দেবো।

করোনা মহামারীর আগে শেষ যেবার কক্সবাজার গেছি বাসের গতি রামুর বর্তমান ফুটবল চত্বরে(!!!) কিছুটা শ্লথ হলে কোন এক যাত্রী দীর্ঘশ্বাসে সশব্দে বলে উঠলেন ‘আহহা,,,খালেকুজ্জামান’।
বোঝা গেলো একজন খালেকুজ্জামান ছিলেন আছেন থাকবেন।