আসাফ উদ্ দৌলা (আশেক)

 

জাতীয় সংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা ঘোষিত ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়ালোকে বাংলাদেশের প্রেক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্ব অনুধাবন পর্যটন নীতিনির্ধারকদের জন্য সময়োপযোগী একটি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে পর্যটনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। একমাত্র সকল খাতের অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধিই এসডিজি অর্জনে সফলতা দ্রুত বয়ে আনতে পারে। এসডিজি’র ১৭ লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে অনেকগুলো খাত সরাসরি ও পরোক্ষভাবে পর্যটনের সাথে সম্পৃক্ত। পর্যটন বিশ্বের অর্থনৈতিক খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম তা নতুন করে বলার কোন প্রয়োজন নেই। বিশ্বে প্রতি দশজনের মধ্যে একজন পর্যটনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য পর্যটনের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন সহজ একটি পন্থা বিবেচিত।
বিশ্বে পর পর দুই বৎসর কোভিড-১৯ মহামারি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় অর্থনীতি ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে। কোভিডের এই প্রভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে। এই পরিস্থিতি হতে উত্তরণ এবং ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পর্যটনই কিকস্ট্যার্ট হিসেবে সাহায্য করতে পারে সরকারকে। দায়িত্বশীল কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যটনশিল্প সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্তদের উত্তরণের মধ্য দিয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা অব্যহত রাখা সম্ভব হতে পারে। তাই অনেক গবেষণা রির্পোটের উপর ভিত্তি করে বিশ্ব পর্যটন সংস্থা এবারের বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে Tourism for Inclusive Growth “অর্ন্তভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে পর্যটন”বিষয়টি নির্ধারণ করেছেন।
বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে যেখানে জাতীয় জিডিপিতে পর্যটনের অবদান প্রায় ৩%, সেখানে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পর্যটনখাত অনেক পিছিয়ে আছে। উন্নত দেশগুলো যত সহজে কোভিড ক্ষয়-ক্ষতি দ্রুত রিকভারী করতে পেরেছে, সে জায়গায় আমাদের মত স্বল্প উন্নয়নশীল দেশগুলো তার ক্ষয়-ক্ষতি রিকভারী করা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কোভিডের প্রভাবে বাংলাদেশের ৪০ লক্ষের অধিক জনগোষ্ঠি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ক্ষতির স্বীকার হয়েছে। এই ক্ষতির প্রভাব প্রশমিত করে পর্যটনশিল্পকে রিকভারী করাই সংশ্লিষ্টদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িঁয়েছে। পর্যটনশিল্পকে সংকট হতে উত্তরণের জন্য গ্রহনযোগ্য কর্মপরিকল্পনা প্রনয়ণের মাধ্যমে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
অর্ন্তভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনে পর্যটনগ্রাম হতে পারে একটি রোড় মডেল। প্রান্তিক জনগোষ্টির ক্ষয়-ক্ষতি রিকভারী এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পর্যটনগ্রাম মডেলের মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রামগুলোকে একসূত্রে গাথাঁ সম্ভব হতে পারে। অন্তত প্রতি উপজেলায় একটি পর্যটনগ্রাম গড়ে তোলার মাধ্যমে সাধারণ জনগণের মধ্যে পর্যটন ধারণার ভিত্তিস্থাপনসহ গ্রামীণ উন্নয়নে পর্যটনকে কাজে লাগানো প্রক্রিয়া প্রণয়ন করা যেতে পারে।
পর্যটনগ্রাম কি এবং কেনঃ
কোন গ্রামকে পর্যটনের মাধ্যমে রূপান্তর (Transformation Through Tourism)-এর উদ্দেশ্যে পর্যটন অনুগন্তব্য (Tourism Micro-destination) হিসেবে তৈরি করলেই তাকে ‘পর্যটনগ্রাম’ বলে। একটি গ্রামকে পর্যটনগ্রাম হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে ঐ গ্রামের সার্বিক উৎপাদনশীলতা বাড়বে, পণ্যের বহুমুখীকরণ সম্ভব হবে এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। গ্রামের মানুষকে গ্রামে রেখে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাস্তবায়নে পর্যটনগ্রাম মডেলকে বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। পর্যটনগ্রাম পর্যটনসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক সেবা ও বহুধরণের নিত্যপণ্য উৎপাদন ও বিপণনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
প্রাণ-প্রকৃতিতে ভরপুর প্রত্যেক গ্রামের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জিবনী শক্তি। সেই শক্তি মানুষকে আপন করে নেয়। বাংলার গ্রামগুলো যেন এক একটা সৌন্দর্য্যের লীলাভুমি। নান্দনিক এবং মনমুগ্ধকর গ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হবে পর্যটনগ্রাম। পর্যটন নিয়ে মানুষের গতানুগতিক ধারণাকে পরিবর্তন করে গ্রামগুলোর সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন শিল্প বিকশিত করতে হবে। গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জিবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি, সরলতা, কৃষি উৎপাদনশীলতাই একটি গ্রামকে পর্যটনগ্রামে পরিনত করতে পারে। পর্যটনগ্রাম বাস্তবায়ন করতে পারলে গ্রামের উন্নয়ন ঘটবে এবং দ্রুতই অর্থনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যাবে। বর্তমান সময়ে পর্যটনকে সাশ্রয়ী এবং জিবনমুখী করা হচ্ছে। পর্যটন গ্রামের কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের উৎপাদন ও বিপনন অনেকাংশে বেড়ে যাবে। একটি গ্রামে ট্যুরিস্ট আকর্ষন সৃষ্টিতে অনেক ধরনের অনুষজ্ঞের প্রয়োজন পড়ে। পৃথিবীর অনেক দেশে পর্যটনগ্রাম রয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৬ সাল হতে টুয়াক কমিনিউটি বেইজড্ ট্যুরিজম প্রমোশনের মাধ্যমে পর্যটনগ্রাম প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে। টুয়াককে কমিনিউটি বেউজড্ ট্যুরিজম প্রমোশনে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এবং ইউএনডিপি সহযোগিতা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে পর্যটনের সুফল পেতে হলে কমিনিউটি বেইজড্ ট্যুরিজম কে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। ওভার ট্যুরিজমের কবল হতে কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনকে রক্ষা করার জন্য প্রতিটি উপজেলায় একটি করে পর্যটনগ্রামের মডেল তৈরী করতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে পর্যটনের উপাদানগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যা বর্হিঃবিশ্বে বাংলাদেশকে অনন্যরূপে তুলে ধরতে সক্ষম।

পর্যটন গ্রামের প্রয়োজনীয়তাঃ
গ্রামীণ উন্নয়নে পর্যটন কৃষি ও অকৃষি কর্মকান্ডের একক এবং যৌথ উন্নয়ন ব্যবস্থা, যা ঐ এলাকার অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের জীবনমানের অগ্রগতি সাধন এবং প্রকৃতি ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন করে। আধুনিক পর্যটনের অর্থ হলো পর্যটনকে সাশ্রয়ী ও জীবনমুখী করা। পর্যটনের উপাদান সমুহের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে জীবনের উৎকর্ষ সাধন করে মানুষের বিশ্রাম, বিনোদন ও শিক্ষার জায়গাকে নিশ্চিত করা যায়। এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হলে আমাদেরকে কৃত্রিম পর্যটন সেবা থেকে সরিয়ে এনে প্রাকৃতিক পর্যটন সেবার দিকে ধাবিত করতে হবে। এই পদক্ষেপ পর্যটনের উলম্ব উন্নয়নের পরিবর্তে অনুভুমিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে, যা আমাদের মতো বহু মানুষের দেশে টেকসই উন্নয়নে নিশ্চিত করতে পারে। উল্লেখ্য যে, অনুভুমিক পর্যটন কাঠামো অধিক সংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।
পর্যটন গ্রামের প্রয়োজনীয়তা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এখন অনুভুত হচ্ছে এবং করোনা প্রভাবের জন্য অদূর ভবিষ্যতে আরো তীব্রতরভাবে অনুভুত হবে। প্রত্যেকেই নিজেদের সম্পদ ও সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে নানা আঙ্গিকে পর্যটন গ্রাম গড়ে তুলছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিচের কারণগুলি বিবেচনায় পর্যটন গ্রাম গড়ে তোলা দরকারি-
ক. পর্যটন গ্রাম হবে পরিচ্ছন্ন ও অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত, যা বসবাসের জন্য অধিক উপযোগী।
খ. কৃষকদেরকে সংগঠিত করে গ্রামে জৈবকৃষির সূচনা হবে, যা গণস্বাস্থ্যের নতুন ভিত্তি রচনা করবে।
গ. মানুষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ও কটেজ আকারের পণ্য ও সেবাশিল্প উৎপাদনে এগিয়ে আসবে।
ঘ. স্বল্পশিক্ষিত মানুষকে প্রায়োগিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উৎপাদনশীল মানুষে পরিণত করা যাবে।
ঙ. পর্যটন সেবাপণ্য উৎপাদন ও সাংস্কৃতিক পণ্যায়ন গ্রামের জিডিপিতে উৎকর্ষী অবদান রাখবে।
চ. মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও শিষ্টাচার বৃদ্ধি পাবে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে।
ছ. প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সকলের মধ্য থেকে দারিদ্র্য দূর করবে।
জ. মানুষের মধ্যে শহরে গমন হ্রাস পাবে।
ঝ. গ্রামে প্রচুর পরিমাণে পরোক্ষ ও আবেশিত কর্মসৃষ্টি হবে, যা মানবিক গ্রাম সৃজনে ভুমিকা রাখবে।
ঞ. পর্যটন গ্রামে বৈদেশিক আয় এবং ব্যাংক ঋণ প্রবাহ সৃষ্টি হবে।
ট. গ্রামে বিশ্বাস, ভালবাসা, সহযোগিতা, ত্যাগ ইত্যাদি জাতীয় সামাজিক পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
ঠ. পর্যটন গ্রামগুলি শান্তির গ্রামে পরিণত হবে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং অর্ন্তভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে পর্যটনগ্রাম বিকশিত করার মাধ্যমে গ্রামীন জনগোষ্ঠিকে উন্নয়ন রোড়ম্যাপে সম্পৃক্ত করার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বিবেচিত হতে পারে পর্যটনগ্রাম। সরকার, এনজিও, আইএনজিও, পর্যটনুরাগী, নীতিনির্ধারক, স্টেইকহোল্ডার, পর্যটন সংগঠন, পর্যটন বিশ্লেষকসহ সকলের এই মুহুর্তে কমিনিউটি বেইজড্ ট্যুরিজম ব্যবস্থাপনার আলোকে পর্যটনগ্রাম প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করতে হবে। সাথে প্রতিটি পর্যটনগ্রামে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় বিশেষভাবে নজরদারি করতে হবে।পর্যটন গ্রামগুলোকে পর্যটকদের কাছে উপস্থাপন করতে গণমাধ্যম ও সোস্যাল মিড়িয়া উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।

লেখক: সচিব- টুয়াক,  ফাউন্ডার কমিটি