ওয়েব ডেস্ক:
‘চুতিয়া’ শব্দ নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছিলেন আসামের চাকরিপ্রার্থী এক তরুণী। আবেদনে যতবারই নিজের পদবি লিখছেন, অনলাইনে ‘সতর্ক’ করে বলা হচ্ছে- অশালীন ভাষা ব্যবহার করা চলবে না!

নিজের পদবি অনলাইনে লিখতে না পেরে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে চাকরির আবেদন করতেই পারেননি ওই তরুণী। শুধু পদবির কারণে চাকরির আবেদন থেকে বঞ্চিত হয়ে ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ধেমাজি জেলার গোগামুখের তরুণী প্রিয়াঙ্কা চুতিয়া।

আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও খামার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে এমএ করা প্রিয়াঙ্কার অভিযোগ, রাষ্ট্রীয় বীজ কর্পোরেশন লিমিটেডের চাকরির পরীক্ষায় অনলাইনে আবেদন করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও আবেদন জমা দিতে পারিনি। আবেদনের সময় প্রতিবার সতর্ক করে বলা হয়েছে, অশ্লীল শব্দ লেখা যাবে না।

আসামের ছয় জনগোষ্ঠীর একটি চুতিয়া। বাকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে মরান, মটক, তাই, আহোম ও কোচ রাজবংশী। পদবির মতো সামান্য কারণে চাকরির প্রথম ধাপ, মানে আবেদনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রিয়াঙ্কা। আসাম-কন্যা একা নন, প্রিয়াঙ্কার এই দুর্ভোগের কথা জানতে পরে তার পাশে দাঁড়িয়েছে চুতিয়া গোষ্ঠী।

বিষয়টি নিয়ে প্রিয়াঙ্কা রাষ্ট্রীয় বীজ কর্পোরেশন লিমিটেডের কাছে অভিযোগ করেছেন। তাদের বক্তব্য, এটি প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে ঘটেছে। অভিযোগ পাওয়ার পর তা ঠিক করে নেয়া হয়েছে।

চুতিয়া সংগঠনগুলো এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, ২০১২ সালেও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে অনেক চুতিয়া পদধারীর অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেয়া হয়েছিল। আসামের জাতিগোষ্ঠীকে এভাবে বারবার অপমান করে নানা দিক থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

চুতিয়া জনজাতির ইতিহাস
আসামের ‘অসমিয়া ক্রনিকল’-এ চুতিয়া জাতির ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। সেখানকার তথ্য অনুযায়ী, এই সম্প্রদায়ের নাম চুতিয়া রাজা অসম্ভিনার নামে রাখা হয়েছিল। তিনি সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বাস করতেন। সেই সময়ে চুতিয়া রাজবংশের লোকেরা বর্তমান ভারতের আসাম ও অরুণাচল প্রদেশে সাম্রাজ্য গঠন করেছিল। ১১৮৭ থেকে ১৬৭৩ সাল পর্যন্ত সেখানে রাজত্ব করেছিল।

এই সম্প্রদায়ের লোকদের দেহের গঠন পূর্ব এশীয় এবং ইন্দো-আরিয়ানের মিশ্র রূপ। আসামে বসবাসকারী এই গোষ্ঠী দক্ষিণ চীন (বর্তমান তিব্বত ও সিচুয়ান) থেকে আসা প্রথম জনগোষ্ঠী বলে ধারণা করা হয়।

চুতিয়াদের রাজত্ব ছিল লক্ষীমপুর ও সুবানসিরী নদীর পেছনের দিকের অংশে। তাঁরা ব্রহ্মপুত্রের উত্তর প্রান্ত থেকে সমগ্র জাতিকে শাসন করতেন। এর আগে তাঁরা তিব্বতি-বর্মণ উৎসের একটি ভাষায় কথা বলতেন। তবে ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্ম গ্রহণের সঙ্গে অসমিয়া ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন।

ভারত সরকারের নথিতে চুতিয়া
চুতিয়া সম্প্রদায়কে সরকার ওবিসি বা অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণিতে রাখে। মূলত অসমিয়া ভাষা বলার লোক হিসেবে তাঁরা বিবেচিত হন।

অসমীয় সংস্কৃতির প্রতীক (ওপর থেকে ঘড়ির কাঁটার দিকে): জাপি, বিহু নাচ, সারাই, বিহু ঢোল এবং গামোসা। ছবি: আজকের পত্রিকা
অসমীয় সংস্কৃতির প্রতীক (ওপর থেকে ঘড়ির কাঁটার দিকে): জাপি, বিহু নাচ, সারাই, বিহু ঢোল এবং গামোসা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গবেষণায় চুতিয়া
বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা, ডব্লিউবি ব্রাউন এবং পবনচন্দ্র সাইকিয়া তাঁদের বইয়ে লিখেছেন চু-তি-য়া মূলত ‘দেওরি চুতিয়া’ শব্দবন্ধটি থেকে এসেছে। এর অর্থ খাঁটি জলের কাছাকাছি বাস করা মানুষ। এখানে ‘চু’ অর্থ খাঁটি, শুদ্ধ বা ভালো। ‘তি’ অর্থ পানি এবং ‘য়া’-এর অর্থ ওই ভূমিতে বাস করা লোক।

আরএম নাথ ‘ব্যাকগ্রাউন্ড অব আসামিজ কালচার’ বইয়ের পটভূমিতে দাবি করেছেন, এখানকার ভাষায় পর্বতশৃঙ্গ (যাকে এখানে চুত বলা হয়) থেকে চুতিয়া শব্দের উত্‍পত্তি। উচ্চ আসামের সমভূমিতে আসার আগে এই লোকেরা পাহাড়ে বাস করতেন। এই সম্প্রদায়ের অনেকগুলো লোকসংগীত রয়েছে, যার মাধ্যমে তাঁরা বলেন যে, তাঁরা ভূমিক্কা এবং সুবাহু চুতনের বংশধর।

চুতিয়াদের ধর্ম
চুতিয়ারা এক আদি পুরুষ দেবতা এবং এক দেবীর উপাসনা করেন। দেবতার নাম কুন্ডিমামা, বালিয়া বাবা অথবা পিশা ডেমা নামেও ডাকেন তাঁরা। কাছারিদের কাছে আবার এই দেবতা বাথাউ বা বাথাউ ব্রাই। আর দেবীকে ডাকা হয় কেচাইখাতি বা পিশাচী-সাই নামে। এ ছাড়া অন্যান্য বড়ো-কাছারি গোষ্ঠীর মধ্যে উপজাতীয় দেবী খেসাই খাইতির উপাসনা দেখা যায়।

অবশ্য চুতিয়াদের অনেকে কালীর বিভিন্ন অবতারের পূজা করেন। আজকাল এই সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ লোকই একসারনা ধর্মের অনুসারী, যা ১৫ শতাব্দীতে আসামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে চুতিয়া সম্প্রদায়ের প্রচুর লোক হিন্দু ধর্মও অনুসরণ করে। এরা অনেক ছোট ছোট সম্প্রদায়েও বিভক্ত।

সূত্র: আসামনিউজ