ড. নাজনীন বেগম:
ভাষাসৈনিক, কবি, প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ, গবেষক যাই বলি না কেন আহমদ রফিক এমন এক জীবন্ত কিংবদন্তি যাকে শুধু নামেই চিনতে কারোরই অসুবিধা হয় না। দীর্ঘ জীবনের বৈচিত্র্যিক ঘটনাবলীর সূক্ষ্ম দ্রষ্টা এই বিশিষ্ট প্রাজ্ঞজন যেভাবে সমাজ, সংস্কার, রাষ্ট্র আর চারপাশের মানুষদের পর্যবেক্ষণ করেছেন তা যেমন বিস্ময়ের একইভাবে শ্রদ্ধারও। ১৯২৯ সালে ১২ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া এই সংগ্রামী প্রাণপুরুষ শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত করেছেন উপমহাদেশীয় উত্তাল স্রোতের বিক্ষুব্ধ আবহে। সঙ্গত কারণে অতি বাল্যকাল থেকেই লড়াকু চেতনায় নিজের অভিগমনকে নিয়ত শাণিত করতে হয়েছে। সৃজন-ক্ষমতায় ঋদ্ধ এই অকুতোভয় যোদ্ধা স্কুল জীবন থেকে বাংলার মাটি ও প্রকৃতির অনবচ্ছেদ মিলন সম্ভারে আবহমান চিরায়ত ঐতিহ্যকে শৈল্পিক সুষমায় লালন করেছেন। আর সেই বোধে কাব্যিক ছন্দোবদ্ধ নান্দনিক শৌর্যকে প্রকাশও করেছেন একেবারে কিশোর বয়সে। নিজের জবানিতে আছে রোমান্টিক আবেগ আর অনুভূতিতে ঝঙ্কৃত কবিতার নির্মাণশৈলী ততটা পাকাপোক্ত ছিল না। পরবর্তীতে যখন মহাবিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পা রাখেন সেই দুর্লভ মুহূর্তে কবিতা ছাড়াও রচনামূলক প্রবন্ধও লিখতে শুরু করেন। সেই অবধি রাজনৈতিক সচেতনতায় নিজেকে সেভাবে তাড়িত করতে পারেননি। ১৫ বছরের উদীয়মান তরুণের কচি-কাঁচা হাতের লেখা গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায় ১৯৫৮ সালে। মাঝখানের সময়গুলোতে সামাজিক-রাজনৈতিক বলয়ের প্রতিকূল পরিবেশ তাঁকে কোন এক আদর্শিক চেতনায় মনোনিবেশ করতে ভেতর থেকে উদ্দীপ্ত করে। রাজনৈতিক সচেতন সময়ের প্রজন্মদের জন্য মার্কসবাদ ছিল একটি অনন্য তত্ত্ব যার প্রতি অনেকেই নিবিষ্ট হয়ে পড়ত। উদার মুক্ত মন, অসাম্প্রদায়িক বোধ তার সঙ্গে মানবিক সত্তা এবং সর্বসাধারণের প্রতি বিশেষ দায়বদ্ধতায় মার্কসবাদ চর্চায় নিজেকে সমর্পণ করেন এই বিজ্ঞ সমাজচিন্তক। মার্কসীয় তত্ত্বকে নিয়ে সেই যে পথ চলা আজ অবধি সেখানেই নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা এই বাম ঘেঁষা রাজনীতিবিদের আদর্শিক চেতনা। তবে সময়ের মিছিলে কোন বিশেষ রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সেভাবে জড়িতও ছিলেন না। নিজের মতো করে দেশকে ভালবাসতেন, সাধারণ মানুষের অধিকার আর দাবির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন তার চেয়েও বেশি শ্রেণীহীন শোষণমুক্ত সমাজের লালিত স্বপ্ন। পরাধীন ব্রিটিশ ভারতের মুক্তির আকা*ক্ষায় উদ্বেলিত তৎকালীন বিশিষ্ট দেশপ্রেমিক মানুষের সঙ্গে পথ চলা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম পর্যায়। সেখানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং সংগ্রামী নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর নাম উল্লেখ্য। লড়াকু ব্যক্তিত্ব নির্ণয়েও সৃজনশীল দ্যোতনা ও আদর্শিক বোধের যে সেতু বন্ধন সেটাই তাকে জীবনভর নির্দিষ্ট লক্ষ্যে চালিত করে। স্কুল-কলেজ জীবনের পরিসমাপ্তি ১৯৪৭ থেকে ৪৯ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিক ও এইচএসসি পাস। ইতোমধ্যে ঘটে যায় ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে দেশ বিভাগ। যাকে এই বিজ্ঞ, আদর্শনিষ্ঠ, আগত যৌবনের টগবগে তরুণ মানতে পারেননি। তাঁর মতে এই ভাগের কোন অনিবার্যতা ছিল না। উত্তাল পরিস্থিতি সামলাতে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ক্ষমতার পালাবদল করে সিংহভাগ মানুষের জীবনে অস্বাভাবিক ও অস্থির পরিবেশ তৈরিতে ইন্ধন যোগায়। যার রেস আজও আমরা টানছি। আহমদ রফিক ’৪৭-এর দেশ বিভাগকে দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ ট্র্যাজেডি হিসেবে চিহ্নিত করেন। এখনও সেই বেদনাকে সঠিক মনে করে সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলে দৃঢ় মত ব্যক্ত করেন। এসব অনাকা*িক্ষত অরাজক পরিস্থিতি দারুণভাবে বিঘ্নিত করে তাঁর ছাত্র জীবনের স্বাভাবিক পথপরিক্রমাকে। মেধাবী ছাত্র হিসেবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির পরও শিক্ষা জীবন পর্যায়ক্রমিকভাবে গতি পায়নি। হরেক রকম বাধাবিপত্তি, বিঘ্নতা মনোযোগী শিক্ষার্থীর জীবনে পথরোধ করে দাঁড়ায়। কারণ ইতোমধ্যে পাকিস্তানী নয়া ঔপনিবেশিক শাসন বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতির ওপর যে আগ্রাসন নীতি অবলম্বন করে সেখানে উদ্দীপ্ত তারুণ্য কখনও নিজেদের সামলাতে পারেনি। আহমদ রফিকও সেই পথযাত্রার একজন বিক্ষুব্ধ সৈনিক যিনি বাংলা ভাষার প্রশ্নে কোন ধরনের আপোসকামিনার বিপক্ষে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ কথিত উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সরকারী সিদ্ধান্তে প্রবল প্রতিরোধে যারা লড়াইয়ে নেমেছিলেন সেই ঐতিহাসিক মহাযজ্ঞে ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিকের নাম আজও উচ্চারিত। দীর্ঘ জীবন পাওয়া এই ভাষাসৈনিক ঐতিহ্যিক আন্দোলনে নিজের অংশীদারিত্বে এখনও গৌরবান্বিত। স্মরণ চেতনায় যা আজও উজ্জ্বল আর অবিস্মরণীয়। ’৪৮ থেকে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সময়ের বলিষ্ঠ পথিক এই দৃঢ়চেতা মানুষটি আজও মাতৃভাষার প্রতি নিবেদিত একজন অকৃত্রিম বোদ্ধা। মাতৃভাষা, মাতৃভূমি, নিজস্ব ঐতিহ্য সংস্কৃতিসহ নৈসর্গিক সম্ভারে সমৃদ্ধ আবহমান বাংলার প্রতি সমস্ত আকা*ক্ষা, প্রত্যাশা, জীবন মেধা-মনন আর কর্মপ্রবাহকে নিবেদনই করেননি পাশাপাশি অর্থবিত্তের প্রতি নির্মোহ চেতনায় সব কিছুকে জয়ও করেছেন। আর সেভাবেই আর্থিক সমৃদ্ধি তাকে কখনও প্রলুব্ধ করতে পারেনি। সাদামাটা জীবনযাপন করে, বাম চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে জাগতিক আকা*ক্ষাগুলো বর্জন করতেও পিছপা হননি। ’৫২ থেকে ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন অবধি পাকিস্তানী শাসকবর্গের একতরফা দমন-পীড়ন নীতিতে অতিষ্ঠ ছাত্র সমাজের অনেকেই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়। সেভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র আহমদ রফিক ও শিক্ষার্থী জীবনে হরেক রকম টানাপোড়েনের শিকার হতে হয়। সেই অসহনীয় পরিস্থিতিতে ঢাকার রাজপথে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে হেঁটে মিছিল করা জীবন আজও স্মৃতির মিনারে ভাস্কর হয়ে আছে। বিভিন্ন বাধাবিপত্তির মধ্যে এক সময় ছাত্র জীবনের পাঠ শেষে হয় ১৯৫৮ সালে। শুধু চিকিৎসক হওয়াই নয়, সে সময় আরও এক প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তে নিজেকে দৃঢ়ভাবে তৈরি করতে হয়। সরাসরি রাজনীতিতে একেবারে সম্পৃক্ত করা নাকি সাহিত্য চর্চায় নিজের মেধা ও মননকে নিবিষ্ট করা। রাজনৈতিক সচেতন এই গুণীজন নিজের সৃজন দ্যোতনাকেও কখনও ছাড়তে পারেননি। বরং এক সময় অনেক বেশি করে শৈল্পিক চেতনায় নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে সমর্পণ করেন। বাম রাজনীতি জীবনের ইতি ঘটলেও মার্কসবাদের চর্চা আর অনুসরণ করা থেকে দূরে সরে থাকেননি কখনও। মার্কসীয় অর্থনীতির প্রতি বিশেষ অনুরক্ত, সমতাভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখা এই শক্তিশালী বোদ্ধা আজও শ্রেণীহীন ব্যবস্থার একজন দৃঢ় সমর্থক। প্রায়ই ৯০কে স্পর্শ করা এই বয়োবৃদ্ধ নেতা এখনও তার নিয়মিত কলামে সর্বসাধারণের মুক্তির অমিত বার্তা যা মার্কসীয় দর্শন থেকে অভ্যুদয় তাকে নানা মাত্রিকে অনুধান করেন। আর মার্কসবাদের চিন্তাশীল ভাবসম্পদ এখনও তার সাহিত্যের বহুমাত্রিক আঙ্গিনাকে প্রভাবিত করে যাচ্ছে। প্রতিদিনের যাপিতজীবন সেই দর্শনেরই সহায়ক ও পরিপূরক। সঙ্গত কারণে বিত্ত-বৈভবের স্থান জীবন ও সমৃদ্ধ কর্মযোগে প্রতিভাত হয়নি। ঢাকায় অনেক মার্কসবাদীর বর্ণাঢ্য ঐশ্বর্যমণ্ডিত জীবনকে আদর্শ হিসেবে মানতে পারেননি। বরং সরদার ফজলুল করিমের মতো আদর্শনিষ্ঠ, বিত্ত-বৈভবের প্রতি নিরাসক্ত, নিবেদিত বাম ঘরানার সাধককে জীবনে চলার পথের দিশারি করেছেন।

শুধু নান্দনিক আবেগে সমৃদ্ধ থেকে সাহিত্য সাধনায় ব্রতী হননি পাশাপাশি প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করেও জীবন ও কর্মের ক্ষেত্র প্রসারিত করেছেন। তাঁর প্রকাশিত ‘নাগরিক’ নামের সাহিত্য পত্রিকাটি তৎকালীন উদীয়মান তরুণদের কবিতা ছাপানোর মাধ্যম ছিল। সৃষ্টির তাড়নায় এক সময় যে লেখক সত্তার বিকাশ কালক্রমে তা জীবন ও জীবিকার মাধ্যম হয়ে ওঠা এক অীনবার্য আর আবশ্যিক পথপরিক্রমা। কারণ অতি বাল্যকাল থেকে নিজের মনন আর মেধায় যে শৈল্পিক বোধ অনুরণিত হয় পরিণত বয়সে তাকেই আরাধ্য দেবতার মতো অর্ঘ নিবেদন করেছেন। ফলে সৃজন ক্ষমতার অনুষঙ্গ হয়ে দীর্ঘ সাহিত্যচর্চা কর্মপ্রবাহকেও চালিত করেছে। তার পরেও তৃপ্তি এসেছে, আদর্শিক চেতনা পরিপুষ্ট হয়েছে, অর্থবিত্তের মোহকে জয় করতে সময় লাগেনি তার চেয়েও বেশি দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতায় নিজের সৃষ্টি আর কর্মকে উৎসর্গ করেছেন।

দীর্ঘ জীবনের তিন শাসনের পালাক্রম অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ যেমন হয়েছে একইভাবে অনেক আশা আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় মুহ্যমানও হয়েছেন। পরাধীন ভারতে কখনও স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি নিয়ে গড়ে উঠতে পারেননি। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে শামিল হতে হয়। ’৪৭-এর দেশ বিভাগ পুরো জাতির জন্য সুখকর কিংবা আকা*িক্ষত ছিল না। নয়া ঔপনিবেশিক শক্তি পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর সশস্ত্র আক্রমণ থেকে শুরু করে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ে হরেক রকম বল প্রয়োগ কখনও স্বাভাবিক জীবনযাপনে নিরাপদ আর নির্বিঘ্ন ছিল না। এই ২৪ বছরের ইতিহাস ও পরাধীনতার গ্লানি বহন করার রিক্ততা আর দুঃসময়ের আবশ্যকীয় ঘটনাপরম্পরা। ’৬০-এর দশকের সংগ্রামী ঐতিহ্য বাঙালীর জীবন ও স্বাধীন সত্তার নব অভ্যুদয়ের এক যুগান্তকারী পর্যায়। যা ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামকে মহিমান্বিত করে। তার পরেও আহমদ রফিক মনে করেন স্বাধীন বাংলাদেশ তার স্বপ্ন আর প্রত্যাশার জায়গায় এখনও যেতে পারেনি। লাগামহীনভাবে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন আর লুণ্ঠণের মতো মহাদুর্যোগ আঘাত হেনেছে। যা কোন স্বাধীন দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে অর্থবহ করে তোলে না বরং বার বার মৌলবাদী ও স্বার্থান্বেষী অপশক্তির অপকৌশলকেই উজ্জীবিত করে। আর এরই ফলে সর্বমানুষের ঐক্যের বাণী ধ্বনিত হয়নি বরং ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের বিভাজন আজও দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান। সমাজ বিশ্লেষক এই প্রাজ্ঞজন সমাজ-সভ্যতার এই ধরনের অবক্ষয়কে কিছু অংশের দূষণ প্রক্রিয়াকে দায়ী করেন। যে শিক্ষা ব্যবস্থায় আগে কোন দুর্নীতির ছাপ পড়েছে বলে জানা যায়নি। এখন সেই পবিত্র শিক্ষাঙ্গনকে বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কলুষিত করা হয়েছে। এটা সমগ্র জাতির জন্য সত্যিই এক মহাসঙ্কট কাল। মার্কসীয় অর্থনীতি যা বলে এখনও তিনি তাই মনে করেনÑ শ্রেণীবিভক্ত সমাজের শ্রেণীস্বার্থ অনিবার্যভাবে শাসক কর্তৃত্ববাদী শ্রেণীর পক্ষে যায়। অসহায়, দুর্বল আর নির্বিত্তদের নানাভাবে শুধু বঞ্চিতই করা হয় না তদের প্রাপ্য অধিকারকেও হরণ করা হয়। নিজের এমনতরো আদর্শিক বোধ আজও তাকে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার প্রতি সচেতন দৃষ্টি ফেরায়। রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হওয়ার চাইতেও তাকে বেশি ভাবায় দেশ ও মানুষের যথার্থ মুক্তির বারতায় তাদের সচেতন করা। মাটি আর মানুষের প্রতি একান্ত দায়বদ্ধতায় যৌক্তিক সমস্ত আন্দোলনের ব্যাপারে তার প্রাসঙ্গিক আলোচনাগুলো আজও সময়ের সফল প্রতিবেদন। স্মরণ করা যেতে পারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে নতুন প্রজন্মের সংহতি প্রকাশ পেয়েছিল ‘গণজাগরণ মঞ্চে’ থাকে তিনি আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মড়কে নিরাপত্তার দাবিতে ছাত্রছাত্রীর রাস্তায় শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণ তাকে উদ্দীপ্ত আর অভিভূত করে। নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে এসব উদীয়মান তরুণের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে বলেও মনে করেন। বিভিন্ন পত্রিকা বিশেষ করে আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, জনকণ্ঠ, সমকাল প্রভৃতি দৈনিক কাগজে তিনি নিয়মিত কলাম লিখে যান। সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যিক চেতনাকেও তার লেখনীর প্রধানতম অনুষঙ্গ করেন। এসব করতে গিয়ে সমাজের গভীরে লালন করা বিভিন্ন অপসংস্কার, অপকৌশলকে চিহ্নিত করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শও তার মনন চেতনার অন্যতম নির্ণায়ক। এখনও সুচিন্তিত অভিমতে, মননশীলতার গভীর অনুভবে ঘটনা প্রবাহের বিচার বিশ্লেষণ যেভাবে তার শক্ত লেখনিতে প্রতিভাত হয় সেখানে বুঝতে অসুবিধা হয় না প্রায় ৯৩-এ পা রাখা এই চিরতরুণ আজও উদ্দীপ্ত চেতনায় সময়ের জয়গান গেয়ে যাচ্ছন। আধুনিকতার বিস্তৃত বলয়কেও নিরবচ্ছিন্ন কর্মপ্রবাহে সম্পৃক্ত করতে দ্বিধা করেন না। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস রচয়িতা আহমদ রফিক আপন সৃষ্টির আঙিনায় তার যুগান্তকারী ভূমিকার স্বাক্ষর রেখেছেন। কবিতায় যেমন সমাজ আর রাজনীতি ভর করে একইভাবে ভাষা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কাব্যিক আবহের অনুবর্তী হয়। আবার ঐতিহ্য, ইতিহাসের সঙ্গে ব্যক্তিক অনুভব আর চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে কবিতার স্বাতন্ত্র্যিক পথচলা। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা, বাংলার মাটি, প্রকৃতি আর মানুষের নিবিড় সান্নিধ্যে কবিতার গতি নির্ণীত হয়, এগিয়ে যায় শেষ অবধি পরিণতিও লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ যেমন নিজেকে কবি বলতে পছন্দ করতেন, বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের মহানায়ক হয়েও। তেমনি এই ভাষাসৈনিক নিজেকে কবি হিসেবে সেভাবে চিন্তা করেন না। তিনি নিজেকে মূলত একজন প্রাবন্ধিক হিসেবেই ভাবতে পছন্দ করেন। সেখানে অবশ্যই সঙ্গত আর যৌক্তিক কারণ আছে। একদিকে যেমন তার প্রবন্ধ সম্ভার কবিতাকে ছাপিয়ে যায় অন্যমাত্রায় এখনও তার সৃজনে আর মননে বস্তুনিষ্ঠ আর যুক্তিভিত্তিক পর্যালোচনা পাঠককে সম্মোহিত করে, মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যায়। শুধু তাই নয় মননশীলতার এই আঙ্গিনায় তিনি এখনও অবাধ আর মুক্তই নন নিরন্তরও বটে। এক সময় প্রবন্ধের জগতে শূন্যতার সৃষ্টি হলে সেই দায়বদ্ধতাকে নিয়ে তিনি এই বিশিষ্ট বলয়কে পথ চলতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তৎকালীন বিশিষ্ট জনের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেন। সেই পর্যায়ক্রমিক লেখনী শক্তি এখনও অবারিত এবং স্বাচ্ছন্দ্য। সাবলীল গতিতে এগিয়ে চলা প্রবন্ধের সারি আজ হাতে গোনার অবস্থায় নেই। অসংখ্য প্রবন্ধের সম্ভারে নিজেকে শুধু সমৃদ্ধই করেননি বাংলা সাহিত্যের আঙ্গিনাকেও অনেকখানি ভরিয়ে তুলেছেন। একজন ভাল লেখক হতে গেলে সবার আগের প্রয়োজন নিজের মনন-দক্ষতা এবং নিবেদিত পাঠক হওয়ার গভীর মনোযোগ। এই দ্বৈত সত্তার মিলনে আহমদ রফিক তার লেখার জগতকে আলোকিত করেছেন। সেই আলোর দ্যুতি ছড়িয়েছে অনেক বিমুগ্ধ পাঠকের চিন্তা আর আদর্শিক বোধে। ’৯৩-এর কোঠায় পা রাখা এই অতুলনীয় গুণীজনকে হৃদয় নিঃসৃত শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর আন্তরিক অভিবাদন। আরও দীর্ঘদিন তিনি আমাদের মাঝে থাকবেন, তার অসাধারণ সৃজন সম্ভারে আমরা সমৃদ্ধ হব তিনি নিজেও সার্থক আর পরিপূর্ণ হবেন।

আহমদ রফিককে নিয়ে অনেক কিছু বলার পরও কত যে এখনও বাকি আছে তা অসংখ্য পাঠকের কাছে একেবারেই অজানা নয়। রবীন্দ্রভক্ত আর অনুরাগীর বিশ্বকবির ভুবনে নিজেকে সমর্পণ করা। সেও এক অভিনব, বিস্ময় আর অভিভূত হওযার বিষয়। একজন কবি, ভাষা আর সংস্কৃতির প্রতি নিবেদিত এক সত্তা রবীন্দ্র অনুভবে নিজেকে বিলীন করবেনÑ এটাই তো স্বাভাবিক। কবিতা লিখেছেন নিজের আবেগে, বাংলার শ্যামল প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে, আরও সাধারণ মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধে। সমকালীন সমাজ, আন্দোলন আর সংগ্রাম তার সঙ্গে একীভূত হয়েছে। তবে কবিগুরুকে মননচেতনায় ধারণ করার ব্যাপারটি একটু ভিন্ন মাত্রার অন্য আঙ্গিকে। যেমন সমাজ, কাল, দেশ যখন চেতনাকে নানা মাত্রিকে আলোড়িত করে একইভাবে সেই কালের মহানায়ক কিংবা প্রতিনিধিরাও বোধে আর অনুভবে নিজের জায়গা করে নেন। রবীন্দ্রনাথকেও নিজের করে পাওয়া আহমদ রফিকের জীবনে সমাজ সচেতনতা কিংবা সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের বহমানতায় এক অবিমিশ্র যোগসাজশ। যখন আবহমান বাংলার সমাজ, সভ্যতা আর সংস্কৃতির বাহন হতে ভেতর থেকে প্রাণিত হন, সময়ও তার সঙ্গে মিশে যায় সেই শুভক্ষণে পথিকৃৎ বা অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বও সমচেতনার ঐক্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আর তিনি যদি হন কোন যুগস্র্রষ্টা কিংবা কালজয়ী তা হতে তো কথাই থাকে না।

ড. নাজনীন বেগম, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্র গবেষক।