মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম

(১)

গত (২৯ আগস্ট) কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিচারণ করে বলেন, “তখন কক্সবাজারের অবস্থা এ রকম ছিল- ছোট ছোট কটেজ, মাটির ঘর ছিল, সেই কটেজ ভাড়া করে থাকতাম। বাবার (বঙ্গবন্ধু) সঙ্গে উখিয়ায় গেছি। তখন উখিয়ায় ঘনজঙ্গল ছিল। উখিয়ায় ঘনজঙ্গল পেরিয়ে যেতে হয়েছে। সেখানে ডাকবাংলোয় ছিলাম। সেখানে বাঘের ডাক, পাখির ডাক শোনা যেতো। হাতি আসতো। যদিও এখন সেখানে সেসবের চিহ্ন নেই। কিন্তু প্রতিবছর তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেতেন। “

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এহেন স্মৃতিচারণে আমাদের স্মৃতিপটে ভেসে উঠে কয়েক দশক আগের ঘন অরণ্য ঘেঁষা শ্রান্ত-শান্ত-প্রাকৃতিক কক্সবাজার। একইসাথে বর্তমানে বিভিন্ন বাস্তবতায় এসব বিলীন হয়ে যাওয়ার আক্ষেপও প্রস্ফুটিত হয়েছে তার এই স্মৃতিকাতর বক্তব্যে। একইসাথে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী থেকে বনায়ন নিয়ে তাঁর ভালবাসা, আকাংক্ষা অনুধাবন, অনুমেয় করা যায়।

(২)

বর্তমানে কক্সবাজারের বনায়ন উজাড় হয়ে যাওয়ার রুঢ় বাস্তবতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উৎকণ্ঠার যথেষ্ট মৌলিক কারণ রয়েছে। দুহাজার সতের সালে আগত রোহিঙ্গা শরনার্থীদের বসতির কারণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার বন ধ্বংস হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য। ধ্বংস হয়েছে ৬ হাজার ১৬৩ হাজার একর বনও। এ ছাড়া বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এশিয়ান হাতির আবাসস্থল ও বিচরণ ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে উখিয়া ও টেকনাফের বনাঞ্চল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে বন বিভাগ। এ ছাড়া রোহিঙ্গা শরনার্থীরা মায়ানমার ফিরে গেলেও জায়গা জবরদখল হয়ে যেতে পারে এবং স্থাপনাগুলো অপসারণ করে বনায়ন করা কঠিন হবে।

এই আশংকা থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি, কক্সবাজারের অত্যাবধি যত বনাঞ্ছল আছে তা ধরে রাখতে আমাদের নির্বাহী সরকার, প্রশাসন, দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদ সহ সবাই আন্তরিক থাকবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে।

(৩)

জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে রুপকথার কোন গল্প নয় বরং কঠিন বাস্তবতা। চলমান সময়ে (গত মাসেই) আমরা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে (আমেরিকা, জার্মান, তুরস্ক) তে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দাবানল, বন্যা দেখেছি যা বিশ্বের সব রাষ্ট্রীয় নেতাদের চিন্তিত, বিচলিত করেছে। বিশ্বায়নের এই যুগে জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে কারণে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ৬০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের উপকূলের ১৭ শতাংশ পানিতে তলিয়ে যেতে পারে।

বিশ্বে যে দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে, বাংলাদেশ রয়েছে সেই তালিকার একেবারে সামনের সারিতে। আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের প্রধান। প্যারিস জলবায়ু চুক্তির পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ডিসেম্বরে ভার্চুয়াল সামিটে দেওয়া ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আজ আমরা ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তির পঞ্চম বার্ষিকী উদযাপন করছি। দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা এই চুক্তির অধীনে আমাদের নির্ধারিত লক্ষ্যগুলোর কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারিনি। বাস্তবতা হল, আমরা বসে থাকলেই জলবায়ু পরিবর্তন বিরতি দেবে না বা তার বিরূপ প্রভাব থেকে আমাদের রেহাই দেবে না।”

এটি অনুধাবন করা যায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় আমাদের অবস্থান আন্তরিক ও প্রাকৃতিক সুরক্ষার পক্ষে। যদিও বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।

(৪)

গত ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সারির দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে আমরা জানতে পেরেছি, সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আরেকটি প্রশিক্ষণ একাডেমি (সাভারে একটি আছে) নির্মাণ করতে ‘রক্ষিত বনভূমির’ ৭০০ একর জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভসংলগ্ন ঝিলংজা বনভূমির ওই এলাকা প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন। বন বিভাগ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির আপত্তি উপেক্ষা করে ভূমি মন্ত্রণালয় এই জমি বরাদ্দ দিয়েছে। বন বিভাগের দাবি, এই জমি তাদের। বরাদ্দ দেওয়া জমির ৪০০ একর পাহাড় ও ৩০০ একর ছড়া বা ঝরনা। তারা জমির মূল্য ধরেছে ৪ হাজার ৮০৩ কোটি ৬৪ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু একাডেমির জন্য প্রতীকী মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ১ লাখ টাকা।

ভারতের জনপ্রশাসনবিষয়ক প্রশিক্ষণের জন্য ন্যাশনাল একাডেমি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মাত্র ১৮৯ একর জমির ওপর ছয়টি ক্যাম্পাসে অবস্থিত। প্রায় দেড় শ কোটি মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য বিশাল জনপ্রশাসনের প্রশিক্ষণ সেখানে হয়। আমাদের ১৮ কোটির দেশে একাধিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র থাকার পরও ৭০০ একরের আরও একটি একাডেমির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু – তা সহজে বোধগম্য নয়।

(৫)

বর্তমানে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রচনায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিছু সমালোচনা, রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা বাদ দিলে প্রশাসনের সৎ, দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাদের অবদানে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে স্ব-মহিমায়।

দু হাজার আঠার সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে পাশ হওয়া ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাংলাদেশে সরকারের একটি সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ। একশ বছরের এই ঐতিহাসিক পরিকল্পনাটি পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সাবেক সদস্য (সাবেক সিনিয়র সচিব) ও বর্তমানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম সাড়ে তিন বছরে তার দক্ষ দল নিয়ে গড়ে তুলেছেন যা অনুমোদিত হয়েছে।

ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক দলিল। একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রযুক্তিগত, কারিগরি ও আর্থসামাজিক দলিল এই পরিকল্পনা। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্র উচ্চতা বেড়্রে যাওয়া, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, ঘুর্ণিঝড়ের তীব্রতা বেড়ে যাওয়া, ঝড় সহ বিভিন্ন দুর্যোগকে আমলে নেওয়া ও এর মাধ্যমে কি ক্ষতি হতে পারে ও এর পরিত্রানের জন্য পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট হয়েছে পরিকল্পনায়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে কক্সবাজার কে র‍্যাংক-১ এ রাখা হয়েছে। সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা র‍্যাংক-১ ও কম দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হচ্ছে র‍্যাংক-৩ এর আওতাভুক্ত। সমুদ্র্যপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, সাইক্লোন, লবণাক্ততা কে এই জেলার ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জলোচ্ছাস থেকে বাঁচার জন্য কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভে বহুমুখী বাঁধ নির্মাণে পরিকল্পনার ছোঁয়া আছে ডেল্টা প্ল্যানে। এছাড়া বাকখালি ও মাতামুহুরি নদী ব্যবস্থাপনার উপর জোরদার করার পাশাপাশি উপকুলীয় অঞ্চলে কৃষি-আবাদ ও চিংড়ি চাষাবাদকে জোর দেওয়া হয়েছে।

এই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাতেই অংকিত হয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বাংলাদেশকে প্রাকৃতিকভাবে স্থিতিশীল, টেকসই রাখার আন্তরিক প্রচেষ্টা।

(৬) [অরণ্যে রোদন]

উপরিউক্ত বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, সাতশত একর [আনুমানিক ৫৫০ ফিফা স্ট্যান্ডার্ড ফুটবল মাঠের সমান] বনায়ন ধ্বংস করে এরকম কৃত্রিম একাডেমি নির্মাণ করার আত্নঘাতিমূলক সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে আমাদের নির্বাহী সরকার, প্রশাসন সদয় হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি, আশা করি।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘হে অরণ্য কথা দাও’ ভ্রমণ কাহিনীতে লিখেছিলেন-

“…এই নির্জন বনের মধ্যে এই অপূৰ্ব গম্ভীর প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে বসে সেই সৌন্দৰ্য্য স্রষ্টার উদ্দেশে প্রার্থনা নিবেদন করি। এই স্থানে বনের পরিবেশের মধ্যে বসে। তাঁর কথাই আগে মনে পড়ে। ওপরে নীল আকাশ, চারিদিকে বনশ্রেণীর নির্জনতা-”

কক্সবাজারের এই অরণ্য আমরা ফিরিয়ে না আনতে পারি- অন্তত রক্ষাত করতে পারি। আমাদের এই রোদন কে ত আমলে নেওয়া কঠিন কিছুনা।

মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ।

কক্সবাজারের নাগরিক।

mmtanim@gmail.com