বাংলা ট্রিবিউন: তাকে সাজানো বিভিন্ন ধরণের বোমা, একেকটি একেক রকম। প্রথম দেখায় যে কারও পিলে চমকে উঠতে পারে। কিন্তু এসব সত্যি বোমা নয়, রেপ্লিকা। দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত বোমা বা আইডি’র (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) রেপ্লিকা তৈরি করা হয়েছে। যা ভবিষ্যতে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে সহায়তা করবে। নতুন করে কোনও বোমা বা আইডি সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহৃত হলে তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে এর উৎপাদক বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যোগসূত্র।

এরকমই একটি অনন্য উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি। তারা তৈরি করেছে বোম ডাটা সেন্টার।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম বোম ডাটা সেন্টার হিসেবে এটি মিন্টো রোডের সিটিটিসি ভবনে চালু করা হয়েছে। বিশ্বের ৩৬ৎতম দেশ হিসেবে এই বোম ডাটা সেন্টার আন্তর্জাতিক বোম ডাটা সেন্টারের তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া চলছে। সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের উদ্যোগে চালু করা হয়েছে এই ডাটা সেন্টারটি।

সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) রহমত উল্যাহ চৌধুরী বলেন, ‘এই ডাটা সেন্টারটি বোম বা আইডি বেইজড জঙ্গি বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী শনাক্ত, অপরাধ চক্রের তথ্য পাওয়াসহ গবেষণার কাজেও ব্যবহার করা যাবে। সারা বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশে এরকম বোম ডাটা সেন্টার রয়েছে। আমরা অত্যাধুনিক একটি বোম ডাটা সেন্টার তৈরি করেছি। ভবিষ্যতে এটি আরও অনেক বেশি সমৃদ্ধ একটি ডাটা সেন্টারে পরিণত হবে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণের পূর্বে বা পরবর্তীতে ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত বোমা বা আইডির নমুনা, প্রকৃতি, ছবি বিশ্লেষণ, নিস্ক্রিয়করণ কৌশল ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা সংক্রান্ত তথ্য এই ডাটা সেন্টারে নিয়মিত আপডেট করা হবে। একইসঙ্গে বিস্ফোরিত বা অবিস্ফোরিত বোমের একটি করে রেপ্লিকা তৈরি করে আর্কাইভে সংরক্ষণ করা হবে। ভবিষ্যতে যে কোন বোমা বা আইডি হামলার ঘটনা ঘটলে ডাটা সেন্টারে সংরক্ষিত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে আইডি ট্রেন্ড ও অপরাধী চক্রকে শনাক্তকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, এই ডাটা সেন্টারে কয়েকটি সেকশনে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো বোমার রেপ্লিকা বিভাগ। এখানে ৬১টি রেপ্লিকা বোমা রাখার স্লট তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ১০-১২টি রেপ্লিকা বোমা তৈরি করা হয়েছে। যেগুলো গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিসহ বিভিন্ন ঘটনায় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো ব্যবহার করেছিল। বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে তৈরিকৃত এসব রেপ্লিকা বোমের কাছে স্ক্যানার মেশিন ধরলেই ডিজিটাল মনিটরে ভেসে উঠবে বোমার উপকরণসহ, কোন জঙ্গি গোষ্ঠী ব্যবহার করেছে এবং কোথায় ব্যবহার হয়েছে; এসবের যাবতীয় তথ্য। এ ছাড়া টেকনিক্যাল ইন্টেলিজেন্স ও কেমিক্যাল এক্সপ্লয়শন সেকশনে বিভিন্ন ধরণের বিস্ফোরক ও বিস্ফোরকজাতীয় দ্রব্যাদির প্রকৃতি ও ধরণ বিশ্লেষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যরা প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বোমা নিস্ক্রিয়করণে আরও বেশি দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আইডি ম্যানিপুলেশন বিভাগে বোমা বা আইডির নমুনা পুনঃগঠন করে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। এ ছাড়া আদালতে বিস্ফোরিত বোমা বা আইডির নমুনা উপস্থাপনের মাধ্যমে এর ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি বোঝানো হবে। আইডি রিসোর্স সেন্টার নামে পৃথক একটি সেকশনে রয়েছে বোমা, আইডি ও বিস্ফোরক সংক্রান্ত নানা বই ও প্রকাশনা। যাতে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা বিস্ফোরক উপাদান, ধরণ, প্রকৃতি, ব্যবহার ক্ষেত্র ও নিরাপদ নিস্ক্রিয়করণ কৌশল ও কেস স্টাডি পর্যালোচনা পর্যালোচনা করতে পারবে। এ ছাড়া ডাটা ফিউশন কর্নার নামে আরেকটি বিভাগে এক্সপ্লোসিভ রেফারেন্স অ্যান্ড সার্চ সিস্টেম (এক্সপ্রেস) নামে একটি অ্যাপ ডেভেলপ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বোমা বা আইডির যাবতীয় তথ্য, ছবি বিশ্লেষণ, নিস্ক্রিয়করণ কৌশল ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা সংক্রান্ত তথ্য দ্রুত বিশ্লেষণ ও মতামত দেওয়া হবে।

ফিঙ্গার প্রিন্টে শনাক্ত করা হবে বোমার উৎপাদক

সিটিটিসির বোম ডাটা সেন্টারে ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে বোমার উৎপাদককে শনাক্ত করারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধারণত দেশের সন্ত্রাসী বা জঙ্গি গোষ্ঠীরা হাতে তৈরি বোমা বা আইডি ব্যবহার করে থাকে। এসব বোমা বা আইডির ওপরে কস্টেপের প্রলেপ দেওয়া হয়। বিস্ফোরিত বা অবিস্ফোরিত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া এসব উপকরণ থেকে যাতে হাতের ছাপ পাওয়া যায় সেজন্য ফিঙ্গার প্রিন্ট শনাক্তের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, অনেক সময় বোমাসহ জঙ্গিরা আটক হওয়ার পরও জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করতে চায় না। ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া গেলে সেই অপরাধীর অস্বীকার করার উপায়ও থাকবে না আবার আদালতের মাধ্যমে তার শাস্তিও নিশ্চিত করা যাবে।

ডাটা সেন্টারের আওতায় আসবে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরাও

সিটিটিসির বোম ডাটা সেন্টারের আওতায় আনা হবে দেশের সকল কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদেরও। ব্যবসায়ীরা সুনির্দিষ্ট কিছু রাসায়নিক উপাদান, যেগুলো দিয়ে বোমা বা আইডি তৈরি করা যায়, সেসব কার কাছে কতটুকু বিক্রি করছে তার আপডেট তথ্য সংযোজন করা থাকবে ডাটা সেন্টারের কাছে। এতে ক্রেতার বিস্তারিত পরিচয়ও উল্লেখ থাকবে। তাহলে কেউ যদি সন্দেহজনকভাবে কোনও রাসায়নিক উপাদান বেশি পরিমাণ সংগ্রহ করে তবে তাকে নজরদারি করা সম্ভব হবে।