আলমগীর মানিক, রাঙামাটি:
১৯৬০ এর দশকে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। ৩৫৬ বর্গমাইল আয়তনের সুবিশাল এই হ্রদে মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে প্রায় ২৫ হাজারের মতো জেলে পরিবার। হ্রদের মৎস্য সম্পদের উন্নয়নে প্রতিবছর সরকার কাপ্তাই হ্রদে নির্দিষ্ট্য তিনমাস সময়কাল হ্রদ থেকে মাছ আহরণ ও বিপননে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। এতে সরকারি হিসেবেই প্রায় ২২ হাজার বেকার হয়ে যাওয়া জেলে পরিবারকে ২০ কেজি করে তিন মাসে ৬০ কেজি চাউল প্রদান করা হয়। একেতো লকডাউন পরিস্থিতি, তার উপর এবছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় কাপ্তাই হ্রদের পানি বৃদ্ধি না হওয়ার কারনে মাছ ধরা বন্ধকালীণ সময়ে আরো ২০দিন বৃদ্ধি করায় জেলে পল্লীতে নিজ নিজ ঘরের মধ্যেই পরিবার পরিজন নিয়ে এক প্রকার বন্দি জীবনযাপন করতে হচ্ছে জেলেদের। এতে করে এই পরিবারগুলোর মধ্যে অভাব অনটন লেগেই আছে। নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ালেও খাদ্য সহায়তা না বাড়ানোয় মানবেতর দিন কাটাচ্ছে কাপ্তাই হ্রদের জেলে পরিবারগুলো।
সরেজমিনের জেলে পল্লীতে গেলে স্থানীয়রা জানান, অন্য বছরগুলোতে পহেলা মে থেকে সরকার কাপ্তাই হ্রদে মাছ আহরণ ও বিপননে তিনমাসের নিষেধাজ্ঞা দিলে আমরা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান নিয়ে সরকারিভাবে প্রাপ্ত ২০ কেজি বিশেষ ভিজিএফ এর চাউল প্রাপ্তির পাশাপাশি রাজমিস্ত্রিকাজসহ স্থানীয় বাজারে বাজার সদাই বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসলেও চলতি মাসে নির্ধারিত সময়ের পর আরো ২০দিন বন্ধকালীন সময় বৃদ্ধি করলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়নি। এতে করে জেলে পরিবারগুলো অভাব অনটনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন বিএফডিসি রাঙামাটি কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক নৌ-বাহিনীর কর্মকর্তা লে: কমান্ডার তৌহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, এবছর অনেকটা অনাকাঙ্খিত ভাবে কাপ্তাই হ্রদের পানি বৃদ্ধি না হওয়াতে আমরা সংশ্লিষ্ট্য সকলে মিলে সময় বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং এটা দ্রুততম সময়ের মধ্যে হওয়ায় আমরা জেলেদের জন্য তাৎক্ষনিকভাবে বরাদ্ধের ব্যবস্থা করতে পারিনি। তিনি জানান, সামনের বছরে প্রতিটি জেলে পরিবারকে ২০কেজি থেকে বৃদ্ধি করে ৩০ করে চাউল দেওয়ার লক্ষ্যে উর্দ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পত্র দিবেন।
অপরদিকে রাঙামাটির জেলাপ্রশাসক মোঃ মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, এবছর প্রত্যাশিত পানির উচ্চতা না বাড়াতে আমরা কাপ্তাই হ্রদের সাথে সংশ্লিষ্ট্য সকলকে নিয়ে বৈঠক করে দুই দফায় ১০ দিন করে ২০দিন নিষেধাজ্ঞার সময় বৃদ্ধি করেছি। এরই মধ্যে আমরা এই বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রদান করা শুরু করেছি। দেখি বিষয়টি নিয়ে কি করা যায়। জেলা প্রশাসক বলেন, যেহেতু এই ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে সেই বিষয়টি নিয়ে আগামী বছর যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেই লক্ষ্যে আমরা এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। হয়তো আগামী বছর কাপ্তাই হ্রদে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ চার মাস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতে পারে এবং সে অনুসারে জেলেদের সহায়তার বিষয়টিও নতুন করে ভাবতে হবে।
প্রসঙ্গত: ১৯৫৬ সালে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলায় কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৬২ সালে বাঁধ নির্মাণ শেষে রাঙামাটির বিশাল এলাকা জুড়ে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম জলাধার কাপ্তাই হ্রদ। এই হ্রদই বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়সমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ। এর আয়তন প্রায় ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর। যা বাংলাদেশের পুকুর সমূহের মোট জলাশয়ের প্রায় ৩২ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ মোট জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ।
১৯৬১ সালে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষে এ হ্রদের সৃষ্টি হলেও এটি রাঙামাটিতে মৎস্য উৎপাদন ও স্থানীয় জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে। এ হ্রদের মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে প্রায় ২৫ হাজার জেলে। কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক প্রজনন নিশ্চিত করাসহ হ্রদের ভারসাম্য রক্ষায় রাঙামাটি জেলাপ্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিবছর তিনমাসের নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে হ্রদের উপর জীবিকা নির্বাহ করা জেলেপরিবারগুলোকে সরকারের ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিশেষ ভিজিএফ কর্মসূচীর আওতায় প্রতিমাসে প্রতিটি জেলে পরিবারকে ২০ কেজি করে তিন মাসে ৬০ কেজি চাউল প্রদান করা হলেও অন্যকোনো সহায়তা একেবারেই পায়না এসব জেলে পরিবারগুলো। তার উপর বর্তমান করোনাকালীন অবরুদ্ধ সময়ে নতুন করে ত্রাণ সহায়তা বিহীন আরো ২০দিনের নিষেধাজ্ঞায় হতদরিদ্র জেলে পরিবারগুলোতে মরার উপর খরার ঘা’ অবস্থা বিরাজ করছে।