আবদুর রহমান খান

 

ভারতীয় সংবিধান থেকে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার সম্বলিত ৩৭০ ধারা বাতিল করে সামরিক জবরদখল প্রতিষ্ঠার দু’বছর পুর্তি হচ্ছে ৫ আগস্ট । সর্বদলীয় হুররিয়াত কনফারেন্স

দিনটিকে কালো দিবস ঘোষণা করে ১০-দিনের প্রতিরোধ কর্মসূচীর ডাক দিয়েছে।

এ কর্মসূচী অনুযায়ী ৫ আগস্ট সর্বাত্মক বন্দ পালন করে শ্রীনগরের ঐতিহাসিক লালচক চত্তরের উদ্দেশ্যে পদযাত্রার আহবান জানানো হয়েছে অবরুদ্ধ কাশ্মীরীদের।

এ ছাড়া ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসকেও কালো দিবস হিসেবে পালন করা হবে এবং সেদিন কাশ্মীরীরা নিজেদের ঘরে স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ থেকে “সিভিল কারফিউ” পালন করবে। কর্মসূচি চলাকালে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিশেষ দোয়া মোনাজাতের আয়োজন করার আহবান জানিয়েছে সর্বদলীয় হুররিয়াত কনফারেন্স।

গত দুবছর ধরে জম্মু-কাশ্মীরে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর চরম দমন-নিপীড়ন, রাত্রিকালীন কারফিউ, ঘেরাও তল্লাশি, গ্রেপ্তার, প্রতিবাদী যুবকদের হত্যা , করোনাকালীন টানা লকডাউন – এ সবকিছু উপেক্ষা করে স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরীরা প্রতিরোধ কর্মসূচীর সমর্থনে দেয়ালে রাস্তায় পোস্টার সাটিয়ে দিচ্ছে। পুলিশ এগুলি দেখামাত্র সরিয়ে নিচ্ছে।

জম্মু-কাশ্মীরের ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠন ইসলামি তানজিম-এ-আযাদী’র সভাপতি আব্দুস সামাদ ইনকিলাবি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতের পার্লামেন্টে কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার হরণের যে একতরফা এবং অন্যায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা কাশ্মীরের জনগণ মেনে নেয়নি এবং কখনই মেনে নেবেনা। তিনি দৃঢ়তার সাথে জানান, পরিপূর্ণ বিজয় না আসা পর্যন্ত কাশ্মীরীরা তাদের আজাদীর লড়াই চালিয়ে যাবে।

তিনি জাতিসঙ্ঘের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে কাশ্মীর সংকটের সমাধানে আন্তর্জাতিক সংস্থাটিকে তার ভূমিকা পালন করতে হবে।

কাশ্মীরে মানবাধিকার লংঘন : ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যদের বিবৃতি

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ১৬ জন সদস্য গত শনিবার ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্টকে একটি চিঠি লিখে ভারতের দখলে থাকা জম্মু-কাশ্মীরে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সোচ্চার হবার আহবান জানিয়েছেন। তারা চিঠিতে লিখেছেন যে, কাশ্মীরিদের কথা শুনতে হবে এবং তাদেরকে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারনের জন্য সূযোগ দিতে হবে। এটা করা একান্তই জরুরী।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এ সদস্যগন মনে করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ভারত ও পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে দেওয়া উভয় দেশের অঙ্গীকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে সহায়তা করা দরকার। তাছাড়া, কাশ্মীর প্রসঙ্গে জাতিসংঘের গৃহীত প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য অনুকূল পরিবেশও সৃষ্টি করতে হবে।

জম্মু-কাশ্মীরের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট সদস্যগণ সেখানকার পরিস্থিতিকে খুবই উদ্বেগজনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা উল্লেখ করেছেন, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেবার পর থেকে সেখানে নাগরিকদের বাক-স্বাধীনতা , সভা-সমাবেশ এবং চলাদফেরার স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। তথ্য আদান-প্রদান এমনকি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে।

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট সদস্যগণ উদ্বেগের সাথে উল্লেখ করেছেন, কাশ্মীরী জনগণের পক্ষে কথা বলার জন্য সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদেরকেও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। নির্বাচিত সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক কর্মী, প্রতিবাদী যুবক এমনকি শিশু-কিশোরদেরকেও অন্যায়ভাবে জেলে আটক করে রাখা হয়েছে।

এ ছাড়া নতুন নতুন আইন প্রবর্তন করে কাশ্মীরীদের দমনের কাজে প্রয়োগ করা হচ্ছে।

ইউরোপিয়ান সদস্যগন উল্লেখ করেছেন, জম্মু-কাশ্মীরের মানবাধিকারের বিষয়টি ছাড়াও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে কাশ্মীরকে ঘিরে ভারত ও পাকিস্তান -এই দুই পারমানবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে সংঘাতের আশঙ্কা। যা এ অঞ্চলের শান্তির জন্য বড় হুমকি হয়ে রয়েছে।

জম্মু-কাশ্মিরের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সেখানকার জনগনের আন্দোলন ক্রমশই সহিংস সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। রক্তপাত ও প্রাণহানি বাড়ছে। কাশ্মীরে ক্রমবর্ধমান সংঘাত দুই প্রতিবেশীর মধ্যেও উত্তেজনা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট সদস্যগণ।

এ প্রসঙ্গে সিনিয়র হুররিয়াত নেতা প্রফেসর আব্দুল গনি বাট বলেছেন, কাশ্মীর ইস্যু ধর্মীয় কোন বিষয় নয়। এটি রাজনৈতিক ইস্যু যা ১৯৭৪ সাল থেকে ভারত ও পাকিস্তান টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছে।

প্রফেসর আব্দুল গনি এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তির স্বার্থে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং কাশ্মীরি জনগণের আকাংখা অনুযায়ী কাশ্মীর সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করতে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি আহবান জানান।

তালেবান সংযোগ নিয়ে ভারতের নতুন দুশ্চিন্তা

আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা এবং তার ন্যাটো মিত্ররা বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যাচ্ছে। তালেবান যোদ্ধারা দেশটির নিয়ন্ত্রণ দখলে নিতে মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আফগান সরকারের পতন এবং তালেবানদের বিজয় এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র ।

এ অবস্থায়, ভারত তার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। এতদিন আফগানিস্তানে আমেরিকার দখলদারিত্বের পক্ষে থেকেছে ভারত। এখন সেখানে বৈরী তালেবানরা ক্ষমতায় ফিরে আসছে এটা ভারতের জন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ও চীনের সাথে বিরাজমান বিবাদের মধ্যে কাশ্মীরের সশস্ত্র স্বাধীনতা যোদ্ধাদের সাথে তালেবান যোদ্ধাদ্দের সংযোগ ভারতের জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টি হবে বলে বিশ্লেষকগণ আশংকা করছেণ।

এটা ভারতের জন্য নতুন একটি “পাকিস্তান-চীন-তালেবান ফ্রন্ট” খুলে দেবে বলে সতর্ক করে দিয়েছে আমেরিকার জো বাইডেন সরকার।

পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর থেকে আফগানিস্তান সীমান্ত ৪০০ কিলোমিটার দূরে। মাঝখানে পাকিস্তান। পাশে চীনের সমর্থন। সব হিসাব বলছে, আগামীদিনে জম্মু-কাশ্মীরে সংঘাতের তীব্রতা আরও বাড়বে।

ভারতের সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ প্রবীণ সহানী সম্প্রতি জার্মান বার্তা সংস্থা ডয়েসচেভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তালেবানরা আফগানবিস্তানের ক্ষমাতায় ফিরে আসলে নিশ্চিতভাবেই তার প্রভাব কাশ্মীরের ওপর পরবে। তিনি মনে করেন, চীন-পাকিস্তান এবং তালেবানদের একটি সমন্বিত ফ্রন্ট গড়ে উঠবে এবং কাশ্মীর তার প্রভাব বলয়ের বাইরে থাকবে না।

গতবছর লাদাখ সীমান্তে চীনের সাথে ভারতের সংঘাতের পর আপাতত; সেখানে পরিস্থিতি শান্ত বলে মনে হলেও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্যরা প্রত্যাহার হবার পর সীমান্ত পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে পারে বলে ধারনা ব্যক্ত করেছেন বিশ্লেষকগণ ।

নিউ দিল্লীর রাজনৈতিক ও ঝুঁকি বিশেষজ্ঞ আকাঙ্ক্ষা নারাইন বলেছেন ১৯৮৮-৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পর বিজয়ী মুজাহিদিন যোদ্ধাগণ চেচনিয়া কাশ্মীর এবং মধ্য-প্রাচ্যে ছড়িয়ে পরেছিল। এবার আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্যরা প্রত্যাহার হলে একই রকম পরিণতি দেখা দেবে।

তখন যুদ্ধপ্রিয় আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়গণ ভারত-কাশ্মীর নিয়ে নতুন যুদ্ধক্ষেত্র সাজাবে।

ভারগতের অপর একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রাহুল বেদী বলেছেন, তালেবানগণ আফগানিস্তান থেকে ইউরোপের সীমান্ত পর্যন্ত খেলাফত প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার থেকে সরে আসেনি; আর পাকিস্তানও কাশ্মীরের ব্যাপারে তাদের প্রচেষ্টায় দৃঢ় রয়েছে। এ অবস্থায়

তালেবানরা পাকিস্তানের পক্ষে শক্তি বৃদ্ধি করবে সেটাই বাস্তবতা। এখানে প্রশ্ন “যদি” নয় “কখন” ঘটবে সেটা দেখার বিষয়।

জম্মু-কাশ্মীর থেকে তালেবানরা এখন ৪০০ কিলোমিটার দূরে আছে। শিগ্রই তারা এমন অবস্থানে পৌঁছাবে সেখান থেকে তারা কাশ্মীরে যুদ্ধবিস্তার করে দিতে সক্ষম হবে। এ ক্ষেত্রে ইসলামিক ধর্মীয় বিশ্বাস, অনুভুতি এবং আবেগ বিশেষ ভুমিকা রাখবে বলে ভারতীয় বিশ্লেষকগণ মনে করছেন। আর সে রমকম পরিস্থিতিতে ভারতে ইসলামি জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে এবং ভারতের নিপীড়িত বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামি বিপ্লবের চেতনা সক্রিয় হতে পারে- এরকম দুশ্চিন্তা করছেন নীতিনির্ধারকগন।

আফগানিস্তানকে যুক্ত করে যারা অখণ্ড ভারতের চিন্তা-ভাবনায় মসগুল তাদের জন্য হতাশার বিষয় হচ্ছে আফগানিস্তানকে ঘিরে নতুন মঞ্চ সাজানো হয়েছে যেখনে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছে পাকিস্তান। সঙ্গে রয়েছে ভারতের শত্রুপক্ষ চীন এবং একদা ভারতের বন্ধু রাশিয়া। আর ভারত এ রঙ্গমঞ্চের বাইরে অবস্থান করছে।

দিল্লী থেকে প্রকাশিত ফোর্স নিউজ ম্যাগাজিনের নির্বাহী সম্পাদক গাযালা ওয়াহাব বলেছেন , কাবুলে সরকার পতনের পর কাশ্মীরে সহিংসতা বৃদ্ধি পেলে তা কেবল তালেবানদের ইসলামি বিপ্লব রপ্তানির কারণেই ঘটবে না। এটা ঘটবে নিজের সৃষ্ট সংকটের মূল কারণ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ভারতের অপদূরদর্শিতার ফলে।

গাযালা ওয়াহাব বলেছেন, ভারত যদি কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণদের অধিকার মেনে নিতো তাহলে আজ কাশ্মীরে রক্তপাত ঘটতোনা; সংঘাত প্রলম্বিত হতোনা। কাশ্মীর সংকটের গোড়ায় হাত না দিয়ে ভারত বরাবরই এটাকে নিছক জঙ্গীপনা, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ বা ভিনদেশী উচকানী বলে দেখাতে চেয়েছে।

তিনি ভারতকে পরামর্শ দিয়েছেন, কাশ্মীর সংকটের সমাধানের জন্য অবিলম্বে পাকিস্তানের সাথে আলোচনা শুরু করতে হবে এবং একটি ন্যায্য ও সন্মানজনক সমাধান খুঁজে সন্ত্রাসের উৎসমুখ বন্ধ করতে হবে। কারণ, উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পারষ্পরিক স্বার্থ রক্ষায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া দুর্বলতা নয়।

(আগষ্ট ০৪, ২০২১ )