সাইদুল করিমঃ
জগতের সব বৃহৎ বিজয় ও বিপ্লব এসেছে তরুণদের তেজোদ্বীপ্ত হিম্মাত আর ভাবনার স্পর্শে।আজকেও তেমনি। তাঁরা রাস্তা মেরামতের পাশাপাশি রাষ্ট্র মেরামতের কাজ করে। একরাশ ঘুমন্ত বিবেককে নিমিষেই জাগিয়ে দেয় ঝাঝালো শ্লোগানে,শ্লোকে আর তাজা রক্তে। পরিবর্তনের দৃঢ় প্রত্যয় আর প্রত্যেক বস্তুকে নতুন আঙ্গিকে সাঁজানোর মানসিকতা তাঁদের নিত্যসূচী।প্রতিবাদ,মিছিল ও যুদ্ধ তরুণের প্রাণ; সত্য,শিষ্টাচার,শৃঙখলা তাঁর অলংকার। অবিচার,অনিয়ম মাথা পেতে প্রতিবাদ বিমূখ কোনো তরুণ বেঁচে থাকতে পারে না। অন্তত তাঁর বেঁচে থাকা শুভা পায় না। তরুণদের অবর্তমানে পৃথিবী নির্জীব,সভ্যতা বর্বর! জল,স্থল ও আকাশ তরুণদের বিচরণে উচ্ছ্বাসিত। তাঁরা কত স্বৈরচারের বুকে এঁকে দিয়েছে গর্বের পদ চিহ্ন; সম্রাজ্যবাদীর রক্তচক্ষু উপড়ে হেসেছে গর্বের হাসি। অসভ্যকে করেছে সভ্য আর বর্বর কে করেছে ভদ্র।

আমরা তরুণ। আমাদের বয়স যুগের হালখাতায় বন্দি থাকতে পারে না। ইতিহাস বিমূখ হয়ে আমরা আমদের পূর্ব পুরুষদের মৃত ঘোষণা করতে আমরা রাজি নই। আমাদের বীর পুর্ব পুরুষগণ তখনই মরে যাবে যখন আমরা মূর্খ হয়ে আমাদের গৌরবগাঁথা ইতিহাস ঐতিহ্য ভুলে যাব। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের সেই তরুণদেরই একজন। বীর পূর্ব পুরুষদেরই একজন। সাহসীদের একজন। যেদিন এ দেশের মানুষ আমাদের সাহসী আর মহান পুরুষদের কথা স্মরণ করতে ইতস্ততবোধ করবে সেদিন বুঝতে হবে এ জাতি,এ দেশ দালালে ভরে গেছে। এই জাতির মননে পচন ধরেছে,মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গেছে।

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ক্ষুরদার লিখনী,আগুনের পুলকি,দখলদারদের পতন ধ্বনি “বিদ্রোহী” কবিতা রচনা করেছিলেন মাত্র একুশ বছর বয়সে। যিনি ছিলেন প্রাথমিক জীবনে মক্তবের শিক্ষক,মসজিদের মুয়াজ্জিন তারপর চায়ের দোকানের রুটি তৈরীর কারিগর। যার বাল্য নাম ছিল দুখু মিয়া। সেই দুখু মিয়ার দু:খ,দুর্দশা,অভাব-অবহেলা প্রতিবাদে প্রতিবন্ধক হয়নি,তার অসহায়ত্ব হয়নি কখনো স্বজাতির মুক্তি আন্দোলনের অজুহাত। আমরাও তাঁর উত্তরসূরী।

আমাদের স্বতন্ত্র ইতিহাস আছে, সংস্কৃতি-সভ্যতা আছে,দর্শন ও জীবন ব্যবস্থা আছে। আমরা মুসলিমরা একটি স্বতন্ত্র সত্ত্বা,ব্যতিক্রম একটি জাতি। সময়ের মোড়লরা যখন গোসল করতে শেখেনি তখনো আমাদের পূর্ব পুরুষরা সাবান ব্যবহার করতো। আমরা কখনো শয়তানের পূঁজা করতে পারি না। আর পারি না শয়তানের সাথে ‘রক্তচুক্তি’ করতে। কাজী নজরুল ইসলাম একুশ বছর বয়েসে কবিতা লিখে কাঁপন ধরিয়েছিল ব্রিটিশের বুকে। আজ যখন সেই নব্য ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তরুণদের দল মিছিল করে,শ্লোগান দেয় তখন কিছু শায়েখরা ফতওয়া দেয় ‘ হারাম হারাম’ বলে! সময় এসেছে এই শায়েখদের বস্তা ভরার!

আমাদের বিরুদ্ধে যতই ফতওয়া আসুক তবু আমরা জালিম স্বৈরচার খুনির ‘মসনদ’ গুড়িয়ে দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কারণ, আমরা জানি-
“আমাদের হাতে একটি মাত্র গ্রন্থ আল
কুরআন,
এই পবিত্র গ্রন্থ কোনদিন, কোন অবস্থায়,
কোন তৌহীদবাদীকে থামতে দেয়নি।
আমরা কি করে থামি” ?

ওরা আমদের কে ভয় দেখায়- আমাদের ক্যারিয়ার ধ্বংস হবে। তারা কি জানে না, আমরা যে হৃদয়ে লালন করি “শাহাদাত” এর চেয়ে বড় ক্যারিয়ার আর নাই।

এসো আজকে একটা যুদ্ধের গল্প শুনি। অশান্ত পৃথিবীর একমাত্র ব্যতিক্রম যুদ্ধ।
এই শতাব্দীর বিশ্বে নেতৃত্বে থাকা রাষ্ট্র,আমেরিকা এই শতাব্দীকে বরণ করেছে মুসলিমদের রক্ত ঝরিয়ে; আফগানিস্থান আর ইরাক আক্রমণ করে। তারা ইরাক কে ধ্বংস করেনি তারা মূলত ধ্বংস করেছে জ্ঞানের নগরী,সভ্যতার পিতৃভূমি কে। সম্ভ্রান্ত মানুষ ক্ষমতা পেলে বিশ্ববাসী সুখ পায় আর ডাকাত-লম্পট-চরিত্রহীনেরা ক্ষমতায় গেলে সম্ভ্রান্তদেরকে অপামান করে। তরুণ তোমাকে অবশ্যই জানতে হবে আর মানুষকে বোঝাতে হবে-‘আমরা ক্ষমতায় গেলে গড়বো আর সংস্কার করবো কখনো ভাঙ্গবো না’।
আমরা জনে জনে বুঝাবো- আসমানী জ্ঞানের সাথে সংযোগহীন জ্ঞান আকাশচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণ করতে পারে কিন্তু মানুষের হৃদয়ে আসীন হতে পারে না।

অষ্টম শতকের শেষ দিকে রোম সম্রাজ্যের নিসোফরাস নামের বাদশাহ বাগদাদের খলীফার নিকট একটি চরমপত্র লিখলেন এভাবে: ”পূর্বে আপনাকে কর হিসেবে যে সম্পদ প্রেরণ করা হয়েছে তা অবিলম্বে ফেরত পাঠাবেন”!
বাগদাদের খলিফা চিঠির উত্তর দীর্ঘ না করে শুধু লিখলেন: “চিঠির উত্তর চোখে দেখতে পাবে”!
সেদিনই বাগদাদের খলীফা বিপুল সেনাবাহীনি নিয়ে রাওনা দিলেন রোমের উদ্দেশ্যে। পরে রোমের অহংকারী বাদশাহ পরাজিত হয়ে পূর্বের তুলনায় অধিক কর দিতে সম্মত হয়ে সন্ধি ভিক্ষা করলেন। কিন্তু খলীফা সাথে একটি অদ্ভুত শর্ত দিয়ে রাজী হলেন। শর্তটি ছিল এই: “আপনার রাজ্যে বিজ্ঞান ও সাহিত্য সম্পর্কে যত বই আছে সেগুলোর একেকটি কপি আমাকে পাঠিয়ে দেবেন আর বিনিময়ে আমি আপনার রাজ্যের অর্ধেক ফিরিয়ে দেব”।

কি অদ্ভূত শর্ত! সম্রাজ্যের বদলে পুস্তক! হ্যাঁ, এটা একমাত্র মুসলিমেদের পক্ষেই সম্ভব। যে সময়ে মুসলিমরা বইয়ের বিনিময়ে রাজ্য ফেরত দিল সে সময়ের আরো আট শত বছর পরে অর্থাৎ ১৬ শতকে খ্রীস্টান সম্প্রদায় বিজ্ঞানী ‘গ্যালিলিও’ এর গবেষণা ও আবিষ্কারকে ধর্মদ্রোহী ফতওয়া দিয়ে নিষেধ করেছিলো।

বন্ধু তুমি আজকে ফতওয়া দাও- অমুকের বই পড়া যাবে না। এর বই পড়লে ঈমান থাকবে না। তুমি জানো ঈমান ভঙ্গের মূল কারণ কোনটি? তুমি ফিতনা ফিতনা বলে হাত পা গুটিয়ে আছো আর আমি অসীম সম্ভাবনার প্রত্যশায় অনবরত ছুটে চলি। যে ঈমানে কারো লিখা পড়লে ভাঙ্গন ধরে সে ঈমান নিয়ে খোদাদ্রোহীদের বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা সম্মুখ সমরে তুমি অংশ নেবে কিভাবে?! যে ঈমান ঠুঙ্কু কারণে ভেঙ্গে যায় সে ঈমান এতো বিস্তৃত কণ্টকাকীর্ণ পথ মাড়িয়ে কিভাবে তোমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে?!

ওহে ভাই ! কেন তুমি পড় না?
একবিংশ শতাব্দী! বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার শতাব্দী; কাছের মানুষকে পর করে আপন করেছে দূরের জনকে। রাত জেগে ফেইসবুক,ওয়াটএপস, টুইটার,ইন্সটাগ্রাম,গুগল প্লাস,ইউটিউব দেখে তোমার রাতটা নিশি হয়। মেসেঞ্জারে টুংটাং শব্দে মেতে থাকো পুরোটা সময়। তবু তুমি কি সন্তুষ্ট কিংবা অপর কেউ?

কেন তোমার দিন শুরু হয় বেলা বারোটায়?

মুহাম্মাদ বিন কাসিমের নাম শুনেছো নিশ্চয়। তোমার আমার বয়সে মানে মুহাম্মদ বিন কাসিমের বয়স যখন সতেরো বছর তখন তিনি ভারত বিজয় করেছিলেন।
তুমি কী জয় করেছো? কারো হৃদয়,বাবা-মার আশা,শিক্ষকের মন,পাড়ার মুরব্বীদের স্বপ্ন? কী করেছো? তুমি পারনি এই জন্যই- কারণ তুমি পড়না।

কেন তুমি পড়না- মহাগ্রন্থ আল কুরআন? কেন তোমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে না গভীর রজনীতে। থরথর করে কাঁপে না তোমার বুক; অন্যায়-অবিচার আর মিথ্যার স্পর্শে। হৃদয়-মননে কেন শিহরন জাগে না কুরআনের মধুর সুরে।

জীবনে কত নাটক দেখেছো,কত মুভি দেখেছো, কত রচনা পড়েছো; জর্জ বার্নাড’শ,শেক্সপিয়ার,সেলি,মিল্টন,ফ্রয়েড,রুমি,ওমর খৈয়ম ও রবিন্দ্রনাথ সমগ্র; তুমি সব পড়েছো আর পড় কিন্তু শুধু কুরআনটা বাদ দিয়েছো! আল্লাহর কালাম তুমি পড়না। কুরআন পড়তে পড়তে তোমার শিহরণ জাগে না, মনটা কাঁদে না, চোখ বেয়ে অশ্রু পড়ে না। তোমার পবিত্র অশ্রু কার জন্য?

ফিজিক্স,কেমিস্ট্রি,বায়োলজি দাগিয়ে পড় অথচ কুরআনের ৬৬৬৬ আয়াত থেকে কখনো কি এক আয়াত দাগিয়েছো; যেটা তোমার জীবনের সাথে মিলে।

তুমি কি জানো? ইবনে সিনা,ইমাম গাজালী,জাবের ইবনে হাইয়ান,আল- বাত্তানী,ইবনে রুশদ,আল ফারাবী সকলে কুরআনের বিশেষজ্ঞ ছিলেন আর ছিলেন রসায়ন,চিকিৎসা,পদার্থ,গণিতের নতুন থিওরীর উদ্ভাবক। তারা বস্তুগত জ্ঞানের সাথে কুরআন তথা ধর্মকে আকড়ে ধরেছিল তাই তারা বিখ্যাত। আর তুমি বস্তুগত জ্ঞান অর্জন করেছো কিন্তু কুরআন তথা ধর্মকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছো তাই কুখ্যাত! কেন তুমি দুয়েক রাত জাগলে না; কুরআন মানুষকে কী চ্যালেঞ্জ দিয়েছে তা দেখতে।

হাদীসের গ্রন্থটা একটু খোল! নামাযে, প্রার্থনায় মন্ত্রের মত দুয়েক বাক্য না বুঝে আরবী না পড়ে এক বাক্য বুঝে পড়,জীবন পরিবর্তন হয়ে যাবে। তোমার চিন্তার পরিধি বাড়বে,জ্ঞানে,গবেষণায়,মতামতে তুমিও হবে অন্যান্য।

শুনতে কি পাও তুমি?