সমাজি বৈঠক

প্রকাশ: ২০ জুলাই, ২০২১ ০৭:৫৭

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


✍️ এহ্সান উদ্দিন

সমাজিবৈঠক। কুরবান ইদের একটি কমন ফেনোমেনন। কংক্রিটের শহরে বোধহয় এ কালচারটির তেমন চর্চা নেই। গ্রামাঞ্চলে কুরবান ইদকেন্দ্রিক ৭০, ৮০ কিংবা তারচেয়ে বেশি বা কম পরিবার নিয়ে সোকল্ড সমাজ গঠনের রেওয়াজটি বহু পুরোনো। তন্মধ্যে পয়সাওয়ালা গোছের একজন সর্দার থাকেন। বছর ওয়াক্তে অর্থাৎ কুরবান ইদের দুএকদিন আগে বাদ এশা সর্দার বাড়িতে কুরবানির পশুর কাটাকুটি নিয়ে এক জরুরি অধিবেশনের নাম মূলত সমাজিবৈঠক হিসেবে পরিচিত। কুরবানির মাংস ভাগ বাটোয়ারার বাইরে তথাকথিত এ ইউনিটির কোনো বিশেষ কাজ নেই। বিশেষত আমাদের গ্রামে বহুকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত এ প্রচলনটি নিয়ে আমার কিছু হাস্যরসাত্মক দুষ্টু-মিষ্ট স্মৃতি রয়েছে। খুব ছোট থাকতে, বয়স কতো হবে তা এক্সাক্টলি বলতে না পারলেও স্মৃতির মানসপটে এখনো দগদগে বাবার সাথে সর্দার বাড়িতে গিয়ে সমাজিবৈঠকের সলাপরামর্শ শুনবার দিনগুলোর কথা। পরিবারপ্রধানগণ বৈঠকে শামিল হয়ে স্ব স্ব মতামত দিতে গিয়ে রীতিমতো শোরগোল পড়ে যেতো। কে কুরবানি দিচ্ছেন, কে কার বাড়িতে গরু ছুলাছুলিতে হেল্প করতে যাবেন, কার বাড়িতে কতোজন কাজপটু মানুষ লাগবে বস্তুত এসবের বাইরে তেমন একটা আলোচনার বিষয় থাকতো না। আমি চা, ব্যালাবিস্কুট খেয়ে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠে বাবাকে চলে আসবার তাড়া দিতাম। বাবা চিমটি কেটে বস্ বস্ বলে আর কিছুক্ষণ বসবার তাগাদা দিয়ে যেতেন। আমি হাঁসফাঁস করে এদিকওদিক বিল বিলিয়ে বিরক্তির লহমা গুনে গুনে শেষপর্যন্ত থেকে গিয়ে বাবার সাথে একগাদা উৎকোচ ভালো না লাগা বগলদাবা করে ঘরে ফিরতাম। পরের বছর আসতে না আসতে তা বেমালুম ভুলে গিয়ে আবারো চা, ব্যালাবিস্কুটে মোহগ্রস্ত হয়ে বাবার পিছু নিতাম। আমার কাছে সমাজিবৈঠক স্রেফ মাংস, ব্যালাবিস্কুট ও ধূমায়িত চা চুমুকের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
অথচ গাঁও গেরামের এ অক্টোপাস বন্ধনটিকে আমাদের চমৎকারভাবে ইউটিলাইজ করবার কতো সুযোগ রয়েছে। কেবল কুরবান ইদকেন্দ্রিক কেনো মুখ দেখাদেখি হবে আমাদের। সমাজে চলতে পথে সুখেদুখে, বিপদেআপদে, অসুখেবিসুখে একে-অপরের বন্ডিং ঝালিয়ে নেবার কতোশতো ঝক্কিঝামেলা প্রতিদিনকার আমাদের চারপাশ ঘুরঘুর করে। এসবে আমরা বেশিরভাগক্ষেত্রে একলা চলো নীতিই অনুসরণ করি। কেউ কারো নয়। এ টাইপের অবস্থা। শ্রেণিবৈষম্যের দুনিয়ায় সমাজটাও ঊনিশে বিশে নয়, দশে বিশে চলে। ধনি গরিবের তারতম্য চিরন্তন বিষয়। কারো সন্তান পয়সার অভাবে পড়াশোনা করতে পারছেন না, মেয়ে বিয়ে দিতে হিমশিম খাচ্ছেন, প্রপার চিকিৎসাভাবে এঘরওঘর দৌড়াদৌড়ি করছেন। ঠিক এ সময়গুলোতে সমাজের সর্দার যিনি থাকেন, তিনি তাঁর মূল রোলটি প্লে করবার মোক্ষম সুযোগটা পেয়ে যান। তাঁর সমাজের চলনসই মানুষজন ডেকে একজায়গায় করে তারপর বলতে পারেন, আমি কিছু দিই, জামাল কিছু দিন, কামাল কিছু দিন, রফিক কিছু দিন। এভাবে তুলাতুলি করে একটি হ্যান্ডসাম এমাউন্ট নিয়ে বিপদাপন্ন মানুষটির পাশে ছুটে যেয়ে তাঁর বিপদ সারাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন। সমাজে অনাচার বৃদ্ধি পেয়েছে। ইভটিজিং হচ্ছে। বাল্যবিবাহ হচ্ছে। যুবসমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। সবকিছু সমাজের হর্তাকর্তাগণ ভালোভাবে এড্রেস করে প্রশমনকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারেন। তাহলে পরে সমাজ গঠনের মূল সার্থকতা প্রতীয়মান হবে। ঐক্যের সমাজ। সৌহার্দ্যের সমাজ। ভালোবাসার সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
কুরবান ইদকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের বন্ডিং বা সমাজব্যবস্থা তৈরি করতে হবে প্রতিদিনের। প্রতিক্ষণের। প্রতিমুহূর্তের।

লেখক: প্রভাষক, কক্সবাজার সিটি কলেজ।