আব্দুল কুদ্দুস রানা

কক্সবাজারে আশ্রিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গাজনগোষ্ঠীর অমানবিক জীবন, তাদের ওপর চালানো সহিংসতা ও নিপীড়ন নিয়ে তৈরি হয়েছে ফিল্ম ডকুমেন্টারি ‘Where Will I go? অর্থাৎ ‘তাহলে আমি কোথায় যাব ?’।

গত ১৯ জুলাই থেকে স্পেনের University of Barcelona তে শুরু হয়েছে International Association of Genocide Scholars এর আন্তর্জাতিক কনফারেন্স!আগামী ২৩ জুলাই পযন্ত চলা এই কনফারেন্সে প্রদর্শিত হচ্ছে ১৯ মিনিটের ওই ফিল্ম ডকুমেন্টারি।

আইনগতভাবে রোহিঙ্গা নির্যাতনকে জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, অভিযুক্তদের বিচারসহ চারটি শর্ত নিশ্চিতকরণে সাধারণ মানুষ ও স্টেইকহোল্ডারদের কাছে বার্তা পৌঁছানোই হচ্ছে এই ফিল্ম ডকুমেন্টারি তৈরির মুল উদ্দেশ্য।

ডকুমেন্টারির পরিচালনা ও প্রযোজক মো. খালিদ রহমান। তিনি রাজধানী ঢাকার ‘আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ এর শিক্ষক, আইনজীবী, গবেষক ও ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার। Where Will I go? তাঁর প্রথম ফিল্ম ডকুমেন্টারি।

ডকুমেন্টারির নির্বাহী প্রযোজক এস এম ফয়সাল আবরার ও ফাহিম কুদ্দুস প্রিয়। সিনেমাটোগ্রাফার ফাহিম কুদ্দুস প্রিয়, আশফাকুর আলম এবং মো. খালিদ রহমান।

ডকুমেন্টারির ভিডিও সম্পাদনা করেন তাহসিন মাহমুদ। তাঁরা সবাই আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী।

ডকুমেন্টাতে কণ্ঠ দিয়েছেন মার্কেটিং স্পেশালিষ্ট সৌমেন্দ্র। আবহ সঙ্গীত বাঁশী বাদক ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক এম কে মুরাদ। ডকুমেন্টারিটির প্রযোজনা সংস্থা দ্য জাস্টিস হাব, ঢাকাস্থ একটি ল ফার্ম । এর কর্ণধার শিহাব আহমেদ সিরাজি।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রাখাইন রাজ্যে সেদেশের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চালানো হয় জাতিগত সহিংসতা, হত্যা-ধর্ষণ এবং বসতিতে আগুন। এরপর আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা জন্মভুমি ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন বাংলাদেশে। এর আগে পালিয়ে আসে আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা । বর্তমানের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ।

আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক ও আইনগত জটিলতার শিকার রোহিঙ্গারা খুব শিঘ্রই তাদের দেশে ফিরতে পারছে না। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এই মানবিক জীবন এবং রাখাইনে সংগঠিত বর্বরোচিত সহিংসতার ওপর নির্মিত হয় ডকুমেন্টারি Where Will I go?

অতিমারি করোনা নিয়ে কক্সবাজারের আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা উদ্বেগ-আতঙ্কে। প্রতিদিন আশ্রয়শিবিরে ২০-৩০ জন শরণার্থী করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন অনেকে। ভারী বর্ষণ-ভূমিধস শরণার্থী জীবনে ফেলছে বিরূপ প্রভাব। এর ওপর ভর করে আছে নিজভুমে ( রাখাইন রাজ্যে) ফিরে যেতে না পারার যন্ত্রণা।

এত কিছুর মধ্যেও রোহিঙ্গাদের মুখে মুখে বাজে একটি গান- ‘ রোহিঙ্গা মুসলমান’। গানটি চরম হতাশা আর দুঃখ বেদনায় ভরা। চার বছর আগে রাখাইন রাজ্য থেকে নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার নেপথ্য কারণ তুলে ধরা হয় গানটিতে। গানটি এখন মিয়ানমারের সামরিকজান্তার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ঘৃণা ছড়ানোর কবিতা। গানটি গেয়েছেন রোহিঙ্গা যুবক হামিদ হুসাইন। নিজের চোখে দেখা ঘটনা ( রোহিঙ্গা বসতিতে আগুন, লুটপাট, নারী ধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞ) এবং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গানটিতে।

গানের কয়েকটি লাইন এরকম,

‘ আরাকানরে বানাই ফেইল্যে কারবল্লার ময়দান/

হাজার হাজার শহীদ গইজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমান/

হাজার হাজার শহীদ গইজ্যে আঁরার মা বইনাইন…।

অর্থাৎ ‘ গণহত্যার মাধ্যমে আরাকানকে (রাখাইন রাজ্য) বানানো হয়েছে কারবালার ময়দান। যেখান শহীদ হয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান। পরিস্থিতির শিকার হাজার হাজার রোহিঙ্গা মা বোনেরা…।

এই গানটিও স্থান পেয়েছে ডকুমেন্টারি ‘Where Will I go তে। রোহিঙ্গাদের আঞ্চলিক ভাষায় এর অর্থ দাঁড়ায় ‘‘তইলে আঁই কড়ে যাইয়্যুম ?

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ( স্পেনে) গত ১৯ জুলাই থেকে রোহিঙ্গা নিপীড়নের এই ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হচ্ছে জেনে খুশী উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। কুতুপালং শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা জালাল আহমদ বলেন, এই ডকুমেন্টারি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধারে বিশ্বজনমত গঠনে বড় ভুমিকা পালন করবে। রোহিঙ্গা নিপীড়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এধরণের ডকুমেন্টারি আর প্রদর্শণ হয়েছে কীনা জানা নেই দাবি করে এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, আমরা দ্রুত নিজভুমে ফিরতে চাই।

ডকুমেন্টারি নির্মানের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল চারটি।

১.রোহিঙ্গার সমস্যার সমাধান শুধু বাংলাদেশের একার দায়িত্ব নয়, এটি সারা বিশ্বের দায়িত্ব, এই বার্তা সকলের কাছে পৌছে দেওয়া,

২. কিভাবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে নির্যাতিত হয়েছিল সেগুলো তুলে ধরা।

৩. আইনগতভাবে রোহিঙ্গা নির্যাতনকে জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিতকল্পে সাধারণ মানুষ ও স্টেইকহোল্ডারদের কাছে বার্তা পৌঁছানো এবং

৪.রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিত কল্পে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

ডকুমেন্টারিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিশিষ্ট দুইজন নাগরিক। একজন অস্ট্রেলিয়ার ড. মিলানিও ব্রায়েন এবং অপরজন জাপানের ড. তেতসুশি ওগাটা।

প্রযোজক মো. খালিদ রহমান বলেন, ‘Where will I Go? ডকুমেন্টারিটি Lift-Off Online Sessions ফেস্টিভালের শর্ট ফিল্ম ক্যাটাগরিতে অফিসিয়ালি মনোনীত হয়েছিল। গত ১৫ জুন ওই ফেস্টিভালে ডকুমেন্টারিটি প্রদর্শিত হয়েছিল । গত ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পযন্ত স্পেনের ইউনিভার্সিটি অফ ভার্সেলুনার আন্তর্জাতিক সন্মেলনে ডকুমেন্টারিটি প্রদর্শিত হচ্ছে। এই কনফারেন্সে কী নোট পেপার উপস্থাপন করবেন ক্যাথরিন মাসুদ। তাঁর পেপারের বিষয়বস্ত Panel on Projections of War: Cinematic Representations of Bangladesh’s Independence।

আশা করছি রোহিঙ্গা অধিকারের প্রশ্নে বিশ্ববিবেক জেগে ওঠবে।

প্রযোজক মো. খালিদ রহমান বলেন, কয়েক দফায় তাঁর দলটি রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে বিভিন্ন বয়সী শরণার্থীর সাক্ষাতকার নিয়েছেন। তাতে রোহিঙ্গা জনগণের ওপর দীর্ঘমেয়াদী এবং সাম্প্রতিক অত্যাচার, বৈষম্য এবং মিয়ানমার রাজ্যের দ্বারা সংঘটিত ব্যাপক সহিংসতা ও নৃশংসতার বিবরণ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে যৌন সহিংসতা (ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং জোরপূর্বক নগ্নতার আকার) রয়েছে। এছাড়া গণহত্যা, জাতিগত সহিংসতা, বলপূর্বক অন্তর্ধান, সম্পত্তি ধ্বংস এবং নির্যাতনের তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এরপরও রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফিরতে চায়। তবে তাদের জীবনের অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গারা ফিরতে পারছে না। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য মিয়ানমারে এখনো রোহিঙ্গা গণহত্যা চলছে। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন যে মিয়ানমার কর্তৃক পাঁচটি শর্ত পূরণ না হলে তারা ফিরে যাবে না।

শর্তগুলি ছিল-

১. মিয়ানমারের নাগরিকত্ব

২. জীবনের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা

৩. বাড়িঘর এবং জমিতে পুনর্বাসন

৪) আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কতৃক মিয়ানমার সরকারকে আস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং তাদের দাবি পূরণের জন্য চাপ প্রদান

৫. আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত কতৃক অভিযুক্ত সামরিক কর্মকর্তা এবং মগ চরমপন্থীদের বিচারের দাবী।

মো. খালিদ রহমান বলেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের দাবিগুলো মেনে নিচ্ছে না তাই তারা হতাশ।

মাতৃভূমিতে ফিরতে পারবে কিনা এই নিয়েও বিরাট দ্বিধায় রয়েছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর ভরণ পোষণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক রাজনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও বাংলাদেশ উভয়ই দ্রুত সমাধানের অপেক্ষায় রয়েছে।

একদিকে রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফিরতে পারছে না। অন্যদিকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের শরণার্থী শিবিরের অমানবিক পরিবেশে জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। এই অনিশ্চয়তার মাঝে রোহিঙ্গাদের মনে একটাই প্রশ্ন-তাহলে আমরা কোথায় যাবো?