ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন
‘মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া’ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় রান্না বিষয়ক রিয়েলিটি শো। সেখানে সারা অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের সেরা রাঁধুনিরা সুস্বাদু এবং মুখরোচক রান্না প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। অস্ট্রেলিয়ার রিয়েলিটি শো মাস্টারশেফের ত্রয়োদশ আসরে অংশ নিয়ে ২য় রাণার-আপ হয়েছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অষ্ট্রেলিয়ান নারী কিশোয়ার চৌধুরী। প্রতিযোগীতার বিভিন্ন স্তরে বাঙালির শেকড়ের রান্না পরিবশেন করে বিচারকদের মন জিতেছেন কিশোয়ার।
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের বাসিন্দা কামরুল চৌধুরী ও লায়লা চৌধুরীর মেয়ে হলেন কিশোয়ার চৌধুরী। ডাক নাম নুপুর। মেলবোর্ন শহরেই কিশোয়ার চৌধুরীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পেশায় কিশোয়ার একজন বিজনেস ডেভেলপার। পরিবারিক প্রিন্টিং ব্যবসাও দেখভাল করেন। দুই সন্তানের মা কিশোয়ার হলেন একজন সখের রাধুঁনি। পেশাদার রান্নার কোনো কোর্স করেননি। সন্তানদের জন্য রাঁধতে গিয়ে মা-বাবার কাছ থেকেই শিখেছেন নানা পদের দেশীয় রান্না।
কিশোয়ারের বাবা কামরুল চৌধুরী হলেন সমাজসেবার জন্য অস্ট্রেলিয়ার রাস্ট্রীয় সন্মাননা “অর্ডার অফ অস্ট্রেলিয়া” পাওয়া একজন নিবেদিত প্রান সংগঠক ও ব্যবসায়ী। তাঁর আদি হল বাড়ি ঢাকায়। সত্তর দশকের প্রথম দিকে তিনি অভিবাসী হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় আসেন। রান্নার প্রতি ঝোঁক থাকায় দেশে থাকতেই কামরুল চৌধুরী পুরান ঢাকার বিভিন্ন বাহারী খাবারের রেসিপি রপ্ত করে ফেলেছিলেন। মেলবোর্নের বাংলাদেশ সমিতির বড় বড় অনুষ্ঠানে সখ করে তিনি নিজেই রান্না করেন। মাস্টারশেফের সেমি ফাইনালে বাবার রেসিপি দিয়ে নেহারী রান্না করেই বাজিমাত করেন কিশোয়ার।
বাংলাদেশী খাবারকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরাটাই ছিল কিশোয়ারের মাস্টারশেফে অংশ নেয়ার মূল লক্ষ্য। তাইতো প্রতিযোগীতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সাথে তিনি বিভিন্ন পদের বাংলাদেশী খাবার পরিবশেন করে গেছেন। এ চাট্টিখানি কথা নয়। এজন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস , অদম্য সাহস ও স্বদেশী সংস্কৃতির জন্য নির্ভেজাল ভালোবাসা।
বিশ্বের বড় বড় শহরে বাংলাদেশী মালিকানাধীন বহু রেস্তোরাঁ থাকলেও, খাবারের টেবিলে দেশীয় খাবারের বদলে মূলত “ইন্ডিয়ার ফুড” পরিবেশন করা হয়। এভাবে ভারতীয় খাবারের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশী খাদ্য।
ইংল্যান্ডে রয়েছে আমাদেরই একজন, কারি কিং খ্যাত টমি মিয়া। ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ান শেফ অফ দ্য ইয়ার প্রতিযোগীতার প্রবর্তক। টমি মিয়া চাইলে হয়তো স্বদেশের খাবারগুলো ইংল্যান্ডের মূলধারার মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারতেন। কিন্তু সেই ঝুঁকি তিনি নেননি। একটি আর্ন্তজাতিক প্রতিযাগীতায় প্রচলিত বিদেশী খাবারের বদলে প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে আবহমান বাংলার খাবারের উপরই আস্থা রেখেছেন কিশেয়ার। এজন্যই তিনি সবার চেয়ে আলাদা।
মাস্টারশেফ প্রতিযোগীতার শুরুতে তিনি তৈরি করেছিলেন আম দিয়ে মাছের ঝোল আর বেগুনের ভর্তা। এরপর পরিবশেন করেন খিচুড়ী, লাউ-চিংড়ি, কুমড়া ভাজি, মাছ ভূনা, যাউ ভাত, ফুচ্কা, চটপটি, আলুর দম, খাসির রেজালা ও পরোটা মত একের পর এক মুখরোচক খাবার। কিশোয়ারের মাছের ঝোল, মাষ্টারশেফ বিচারকদের চেটে পুটে খাওয়াটাই প্রমান করে দেয় আমাদের শেকড়ের খাবারগুলোও বিশ্বমানের।
প্রতিযোগীতার সেমি ফাইনালে কিশোয়ার রেঁধেছেন নেহারীর মত ঐতিহ্যবাহী জটিল পদ। তবে শেষে পানের মোড়কে তৈরী ডেজার্ট ছিল কিশোয়ারের মাস্টার স্ট্রোক, যা তাঁকে নিয়ে যায় গ্র্রান্ড ফাইনালে। পানের সাথে আইসক্রীম মিশিয়ে কিশোয়ারের তৈরী অভিনব ডেজর্টি “দি বেঙ্গলি আফটার ডিনার মিন্ট” দেখে চমকে উঠেছিলাম। বিচারকদের অদ্ভূত ভঙ্গীমায় পান খাওয়া দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল শেফারী ঘোষের গাওয়া বিখ্যাত গান – বক্সির হাটের পানের খিলি তারে বানাই খওয়াইতাম!!
এরপর গ্রান্ডফাইনালের প্রথম দিনে মারাত্মক ঝুঁকি নিলেন কিশোয়ার। পরিবেশন করলেন আমাদের প্রানের উৎসব বৈশাখের প্রতীকি খাবার পোড়া মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত, যা তিনটি বিচারকের কাছেই পেলো দশে দশ। পান্তা ভাতকে আমরা কৃষকের খাবার বলে অনেকেই অবজ্ঞা করি। বৈশাখের সময় আবার ফ্যাশন করে পান্তা ইলিশও খাই। কিন্তু এই পান্তা ভাতকেই ফাইন ডাইনিংয়ের মেন্যুতে তুলে এনে কিশোয়ার দিলেন শৈল্পিক মাত্রা।
অস্ট্রেলিয়ায় বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের যেসব ছেলে-মেয়েরা বাঙালি খাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল, শুনলাম তারাই এখন লাউ-চিংড়ি ও আলু ভর্তা খেতে মায়ের কাছে বায়না ধরছে। নতুন প্রজন্মকে স্বদেশমুখী করার এই কৃতিত্ব কেবল কিশোয়ারের। এ অনেক বড় অর্জন।
কিশোয়ার একটি রান্নার বই লিখতে চান যা দেখে যে কেউ সহজেই বাংলা খাবার তৈরি করতে পারবেন। আমার বিশ্বাস, কিশোয়ারে এই বাধ ভাঙ্গা সাফল্যে আত্মবিশ^াসী হয়ে প্রবাসের অনেক বাংলাদেশী ব্যবসায়ী তাদের রেস্তোরাঁয় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন করবেন। এভাবে হয়তো একদিন ইন্ডিয়ান ফুডের তকমা ঝেড়ে ফেলে স্বদেশের মুখরোচক খাবারগুলো স্ব-মহিমায় হাজির হবে বিশে^র নামি দামী রেস্তাঁরার টেবিলে।
মাস্টারশেফ শিরোপা জিতেননি, তাতে কি? বিশ্বজুড়ে লক্ষ কোটি বাঙালি মন জয় করেছেন কিশোয়ার। বাংলাদেশি কুইজিন” বলে কিছু আছে, এইটা উনি সারা দুনিয়াকে দেখিয়েছেন। তাইতো কিশোয়ারই হলেন বাংলা খাবারের অন্যতম ব্য্রান্ড অ্যাম্বেসেডর।
(লেখক: সিডনী প্রবাসী নগর পরিকল্পনাবিদ, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট গীতিকার, কক্সবাজারের কৃতি সন্তান।)