বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম:
চট্টগ্রামের পটিয়ার সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীসহ ছয়জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েশ এই আদেশ দেন।

সোমবার (২১ জুন) দুদক ও আদালত সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
গত ৮ জুন মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েশ আদেশটি দেন; যাতে গত ১৩ জুন তিনি স্বাক্ষর করেন।

ওইদিনই পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পক্ষ থেকে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

আরও যাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
আদালত আরও যে ৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন তারা হলেন- সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম প্রধান সাজ্জাদুল ইসলাম, গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) মো. আব্দুল হাই এবং ঢাকার ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের কর্মচারী আবুল কালাম আজাদ।

গত ৭ জুন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন তাদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞার আবেদন করেন। যেখানে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকর্তাদের শত শত কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে বড় বড় ঠিকাদারী কাজ নিয়ে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাত, ক্যাসিনো ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকা অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্জনপূর্বক বিদেশে পাচার ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে এবং অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তিনি জানতে পারেন যে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত ব্যক্তিরা দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারেন সেজন্য ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন, ল্যান্ড অ্যান্ড সি পোর্ট) স্পেশাল ব্রাঞ্চ, বাংলাদেশ পুলিশ, মালিবাগ বরাবর অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা একটি পত্র প্রেরণ করেন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিদেশ গমন নিষেধাজ্ঞা প্রদানে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন নং ৮২৪/২০২১ সংক্রান্তে গত ১৬/৩/২১ ইং তারিখে রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশ মোতাবেক আদালতের পূর্বানুমতি গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে।

দুদকের পক্ষে আবেদনের ওপর শুনানি করেন কৌঁসুলী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর।

শুনানি শেষে আদালতের আদেশে বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিদেশে পালিয়ে গেলে অনুসন্ধান কার্যক্রম দীর্ঘায়িত ও ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা কর্তৃক দাখিলকৃত দরখাস্ত ও অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় দরখাস্তটি মঞ্জুরযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়। সেই সাথে বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন, ল্যান্ড অ্যান্ড সি পোর্ট), স্পেশাল ব্রাঞ্চ, বাংলাদেশ পুলিশ, মালিবাগ এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ঢাকাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করা হলো।

ক্যাসিনোকাণ্ডসহ বিভিন্ন উপায়ে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে হুইপ সামশুল হকের নাম। অভিযোগ আছে তার সম্পদের পরিমাণ এক হাজার ৫৪৬ শতাংশ বেড়েছে।

অনুসন্ধান শুরুর পর ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর সামশুল হকের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইমিগ্রেশনে চিঠি দিয়েছিল দুদক।

হুইপের ছেলে নাজমুল করিম চৌধুরী শারুনসহ তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির ব্যাপারেও অনুসন্ধান চলছে।

যা বলছে দুদক
দুদকের পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনুসন্ধান দলের প্রধান কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেন সোমবার বলেন, এর আগে দুদক সামশুল হক চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজনের বিদেশযাত্রায় যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, সেই নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল যে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞায় আদালতের অনুমতি নিতে হবে। সেই অনুযায়ী আদালতে আবেদন করা হয়। আদালত তা মঞ্জুর করেছেন।

হুইপ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেশজুড়ে জুয়া, ক্যাসিনো বন্ধে র‌্যাবের অভিযান সম্পর্কে সমালোচনা করে বিতর্কের জন্ম দেন সামশুল হক চৌধুরী। চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাবে অভিযানের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান। জুয়ার পক্ষে সাফাই গান।

হুইপের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাবে জুয়ার আসর বসিয়ে ১৮০ কোটি টাকা অবৈধ আয়ের অভিযোগ তোলেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। অদৃশ্য শক্তির ইশারায় ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়।

এছাড়া হুইপ সামশুল হক চৌধুরী আবাহনী ক্লাবে জুয়ার আসর বসিয়ে দিনে ছয় লাখ টাকা আয় করেন বলে অভিযোগ তোলেন ক্লাবের ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান এবং নগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক দিদারুল আলম চৌধুরী। এ কারণে দিদারুলকে হত্যার হুমকি দেন হুইপের ছেলে শারুন।

দুদক সূত্র জানায়, ক্লাবে জুয়ার কারবারে জড়িত থাকার প্রাথমিক তথ্য মিলেছে হুইপের বিরুদ্ধে। নির্বাচনী হলফনামায় প্রদর্শিত সম্পদের বাইরেও নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন সামশুল ও তার স্ত্রী। বিদেশে পাচার করেছেন বিপুল অর্থ।

তিন নির্বাচনের আগে দেওয়া হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হুইপ সামশুল ও তার স্ত্রী রীতিমতো আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন।

হলফনামা ২০০৮
২০০৮ সালে নির্বাচনে শ্যালক ও ভায়রার কাছ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা এবং নিজের মাত্র ৫০ হাজার টাকা নিয়ে সংসদ নির্বাচনের মাঠে নেমেছিলেন সামশুল। ওই সময় তিনি এতই দরিদ্র ছিলেন যে তার হাতে নগদ টাকা ছিল মাত্র এক হাজার ৩৬৯ টাকা। আর তার স্ত্রীর কোনো সম্পদই ছিল না। সম্পদের পরিমান দেখিয়েছিলেন ২১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৬৯ টাকার।

হলফনামা ২০১৪
পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামায় দেখা যায়, সামশুলের সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৫৩০ শতাংশ। এই সময় তার স্ত্রী লাখপতি হয়ে ওঠেন। ২০১৪ সালে নিজেই ব্যয় করেন ২০ লাখ টাকা। এই সময় সামশুল হকের ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ৪০ লাখ ১২ হাজার ৩৬৬ টাকা। ২০০৮ সালে তার একটি প্রাইভেট কার ছিল। ২০১৪ সালে সেটি পরিবর্তন করে ৬১ লাখ ৫০ হাজার টাকা দামের গাড়ি কেনেন তিনি। পটিয়ার রশিদাবাদ গ্রামে নির্মাণ করেন প্রাসাদোপম বাড়ি।

হলফনামা ২০১৮
২০১৮ সালের হলফনামায় দেখা যায়, দম্পতির ভূ-সম্পত্তি বেড়েছে ৩২ লাখ টাকার। অস্থাবর সম্পদের সঙ্গে ডলার যুক্ত হয় প্রায় ২৭ লাখ টাকার। ব্যাংকে জমা ছিল ৯২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ৬৩৮ টাকা। স্বামী-স্ত্রী দুজনের বন্ড বা ঋণপত্র সম্পদ যুক্ত হয়ে পাঁচ লাখ টাকার সঙ্গে ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও অলংকারের পরিমাণও বাড়ে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পাহাড় আড়াল করতে সম্পদের মূল্য নামমাত্র দেখিয়েছেন হলফনামায়। কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাড়ির নির্মাণ ব্যয় দেখানো হয়েছে মাত্র ৪৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। রিয়াজুদ্দিন বাজারের মতো একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় ৯০০ বর্গফুটবিশিষ্ট চারতলা ভবন তথা তিন হাজার ৬০০ বর্গফুট ভবনের মূল্য উল্লেখ করেছেন দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা।

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা সামশুদ্দিন আহমেদকে হত্যার হুমকিদাতা জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, তার ছোট ভাই মুজিবুল হক নবাব ও হুইপপুত্র নাজমুল করিম শারুনের বিরুদ্ধে গত ৫ জুন জুতা মিছিল করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও মুক্তিযোদ্ধা চেতনা প্রজন্ম। মিছিল থেকে তারা অবিলম্বে হুইপ, তার ভাই ও ছেলে শারুনের গ্রেপ্তার ও হুইপের পদ থেকে বহিষ্কার এবং সংসদ সদস্য পদ শূন্য ঘোষণার দাবি জানায়।

গত ৯ জুন হুইপ পরিবারের বিরুদ্ধে মিছিল সমাবেশ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনতা। চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন আহমদকে প্রাণ নাশের হুমকি প্রদানসহ নানা অভিযোগে বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মান সংরক্ষণ পরিষদ এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে।

গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর হুইপ সামশুল হকের কুশপুত্তলিকায় ঘৃণা প্রদর্শন এবং তা ঢাকঢোল পিটিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে প্রতিবাদ জানায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন করে সংবিধান লঙ্ঘন ও শপথভঙ্গের অপরাধে সামশুল হক চৌধুরীকে অপসারণেরও দাবি জানানো হয়।

সূত্র জানায়, যুবদল ও জাতীয় পার্টির রাজনীতি থেকে ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগে এসে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সামশুল হক চৌধুরী। মাত্র ১০ বছরে তার সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে এক হাজার ৫৪৬ শতাংশ।