প্রেস বিজ্ঞপ্তি:
আন্তর্জাতিক ‘নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের প্রতি সমর্থন’ দিবস উপলক্ষ্যে ব্লাস্ট কর্তৃক আয়োজিত ‘নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির আইনগত সুরক্ষায় করণীয় ’ বিষয়ক অনলাইন মত বিনিময় সভায় বক্তারা নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির জন্য ক্ষতিপূরণ তহবিলে প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেন। আগামী ২৬ জুন ২০২১ ‘নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের প্রতি সমর্থন’ দিবস আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিপালিত হয়ে আসছে। এরই আলোকে ব্লাস্ট ২৪ জুন ২০২১ ইং তারিখ নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির আইনগত সুরক্ষায় করণীয়’ বিষয়ক অনলাইন মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। বিশিষ্ট আইনজীবী এবং ব্লাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য জেড আই খান পান্না বলেন একজন ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার পরিবার যেই অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তা কোনোভাবেই টাকার অংকে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয় – সেজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের আইনগত সুরক্ষা থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন আইনের ব্যত্যয় হলে যদি আমরা মামলা করতে এগিয়ে না আসি, তাহলে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি কখনোই প্রতিকার পাবে না।
ব্লাস্টের অনারারী নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, আমাদের সংবিধানে নির্যাতন থেকে মুক্তির অধিকার সুরক্ষিত আছে এবং পরবর্তীতে আমরা এই বিষয়ে সুস্পষ্ট আইন ও আদালতের বেশ কিছু রায় পেলেও বাস্তব চিত্র অনেকটাই এর বিপরীত। এক্ষেত্রে আমাদের নীরবতা ও পিছু হটার মানসিকতা পরিবর্তন করে সাহসীভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আরো বলেন, হেফাজতে নির্যাতন হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে চিকিৎসকদের ভূমিকা অনেক। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইস্তানবুল প্রটোকল থাকলেও বাংলাদেশে চিাকৎসকরা এই বিষয়টির সাথে পরিচিত নন।
পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণকারী জনির ছোট ভাই মোঃ ইমতিয়াজ হোসেন রকি বলেন যে, তার ভাই এর মৃত্যুর পর পুরো পরিবারটি অচল হয়ে যায়। তিনি মনে করেন, এধরণের পরিস্থিতির শিকার ব্যক্তিদের সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত এবং এজন্য একটি সরকারী তহবিল গঠন করা প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে পা হারানো মোঃ লিমন হোসেন বলেন, এ ধরণের মামলা পরিচালনায় সবক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের প্রবিতন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় যে ক্ষতিগ্রস্তরা একটি পর্যায়ে এসে ধৈর্য হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন।
সমাজের খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার, ড. মনীষা চক্রবর্তী বলেন যে রাষ্ট্রের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।
ব্লাস্টের গবেষণা বিশেষজ্ঞ তাকবীর হুদা বলেন, আইন কমিশন অপরাধের শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য একটি আইন প্রস্তাব করে ২০০৭ সালে। এ প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনা করে আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন
সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ব্যরিস্টার মোঃ আব্দুল হালিম বলেন, নির্যাতনের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রাথমিক দায়িত্ব সরকারের, কেননা সরকার আমাদের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা দিচ্ছে। ভারতে এ ধরণের নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ প্রদানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । আমাদের দেশেও এধরণের একটি ব্যবস্থা থাকা উচিত।
ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এড. রেজাউল করিম বলেন, আমাদের উত্তরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনটির ব্যাপারে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতার অভাব। এই সচেতনতার অভাবেই অদ্যাবধি এই আইনের অধীনে সেরকম কোনো মামলাই হয়নি। এই আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের জোরালো ভাবে কাজ করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের আওতায় সাধারণ মানুষ ভয়ে নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে মামলা করে না এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহ বিচারপ্রক্রিয়ার অন্যান্য অংশীজন এ আইনের যথাযথ প্রয়োগে সক্রিয় নন।
এডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘ ভারতের এই অপরাধ ক্ষতিপূরণের নীতিমালার পাশাপাশি বাংলাদেশও একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে, যেটির বাস্তবায়নে আমাদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে।’’
সভায় অংশগ্রহণকারীগণ বলেন ,আমাদের সকলের নির্যাতন হতে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনে নির্যাতন হতে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারকে মৌলিক অধিকারের মর্যাদা দেয়া হয়েছে । একজন অপরাধী ব্যক্তিরও আইনানুযায়ী বিচারকার্য সম্পাদন হওয়ার অধিকার রয়েছে।
উল্লেখ্য ২০১৩ সালে বাংলাদেশ “হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারন) আইন” পাশ করা হয়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, এই বছরের জানুয়ুারি থেকে মে মাসে পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসে মোট ৩০ জন বিচারিক হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। একই সময়ে, ৩১ জনের কারাগারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। নয়টি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা এবং কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের ভিত্তিতে এই তথ্যগুলি মূল্যায়ন করা হয়েছে।
হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারন) আইনটি গত ২০১৩ সালের অক্টোবর এ পাশ হলেও এই পর্যন্ত প্রায় ৮ বছরে এই আইনের আওতায় গুটিকয়েক মামলা রজু হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৭ বছর পর গত ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ দেশে সর্বপ্রথম এই আইনের আওতায় পুলিশি হেফাজতে মোঃ জনির মৃত্যুর ঘটনায় দায়েরকৃত হত্যা মামলার রায় প্রকাশ পায়।
ব্লাস্ট এর অনারারী নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন এর সঞ্চালনায় বক্তব্য প্রদান করেন বরিশাল ব্লাস্টের প্যানেল আইনজীবী হিরণ কুমার দে, এডভোকেট সাহিদা তুলকদার সহ প্রমুখ। সভায় আইনজীবী, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীগণ অংশগ্রহণ করেন। সর্বোপরি, বক্তাগণ নির্যাতনে শিকার ব্যক্তিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রচলিত আইনের যথাযথ পরিবর্তন এনে রাষ্ট্রীয় ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা প্রচলন ও আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে সকল ধরনের নির্যাতন প্রতিরোধ করার দাবি জানান ।