বাংলা ট্রিবিউন : আদালতে জাল নথি কিংবা তথ্য গোপন করে জামিন নেওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। অবৈধ পন্থায় উপার্জনের আশায় এসব জালিয়াতির ঘটনায় কিছু আইনজীবীও জড়িয়ে পড়ছেন। তাদের এই অপকর্মের কারণে একদিকে যেমন আইন পেশার সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তেমনই বিপদে পড়ছেন সাধারণ আইনজীবীরা। সম্প্রতি এমনই এক জালিয়াতির ঘটনায় শক্ত অবস্থান নিয়েছে হাইকোর্ট।

ঘটনার সূত্রপাত বগুড়ায় হাইকোর্টের নথি জালিয়াতি করে ‘ভুয়া আগাম জামিন’ আদেশ তৈরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এর আগেও বিভিন্ন মামলায় জালিয়াতির চেষ্টা করলেও আসামিদের সংখ্যাধিক্য বিবেচনায় বগুড়ার ঘটনাটি ছিল সবচেয়ে বড়। এ জালিয়াতির ঘটনায় স্থানীয় যুবলীগ নেতাসহ ৩০ জন আসামি, ২ আইনজীবী (রাজু আহমেদ রাজিব ও তানজিম আল মিসবাহ) সহ ৩৪ জনের নাম উঠে আসে। এই জালিয়াতি ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ-সিআইডি।

বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যারিস্টার কাজী মারুফুল আলমের মাধ্যমে জামিন সংক্রান্ত একটি মামলার সূত্র ধরেই ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী রাজু আহমেদ রাজীবের সঙ্গে পরিচিয় ঘটে বগুড়ার আইনজীবী তানজিম আল মিসবাহ’র। আইনজীবী তানজিম বগুড়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবেও দায়িত্বে রয়েছেন। পরিচয়ের সূত্র ধরে তানজিম জানতে পারেন, আইনজীবী রাজিব ঢাকায় ব্যারিস্টার তানজিব উল আলমের চেম্বারে জুনিয়র হিসেবে কাজ করেন। তাই দিনে দিনে পরিচয়ের সূত্র ধরেই আইনজীবী রাজিব বগুড়ার আইনজীবী তানজিমের কাছে প্রায়ই মামলা পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে অনুরোধ করে আসছিলেন। এরপর তানজিমের বেশকিছু মামলায় রাজিব আদেশ পাইয়ে দেওয়ায় তাদের মধ্যে সখ্যতাও বৃদ্ধি পায়।

পূর্বের সখ্যতার মতোই চলতি বছরের গত ১১ ফেব্রুয়ারি বগুড়ায় মোটর মালিক গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ৩০ জন (আসামি) মক্কেলকে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন করাতে রাজিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তানজিম। জামিন করানোর বিষয়ে ‘শিওর শট’ বলে তানজিমের মক্কেলদের আশ্বস্ত করেন রাজিব। বগুড়া থেকে মামলার প্রয়োজনীয় নথিও রাজিবের ফেসবুক মেসেঞ্জারে পাঠান তানজিম। আর রাজিবের বিকাশ নম্বরে পাঠানো হয় টাকা।

এরপর গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজিব ফোন করে তানজিমকে জানান, আসামিদের ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন হয়ে গেছে। পরে রাজিবকে ‘ল ইয়ার সার্টিফিকেট’ পাঠাতে বলা হয়। কিন্তু তা পাঠাতে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে বলেন রাজিব এবং হাইকোর্টের সার্টিফায়েড অর্ডারের কপি পাঠাবেন বলেও জানান। পরে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজিব হাইকোর্টে অবস্থিত এসএ পরিবহন শাখার মাধ্যমে তানজিমের কাছে হাইকোর্টের জামিন আদেশের কপি পাঠান। এর পাশাপাশি মেসেঞ্জারে ডকুমেন্টস জমা দেওয়াসহ রাজিবের ‘লিগাম কনসোর্টিয়াম’ নামের চেম্বারের কাগজপত্রও পাঠানো হয়। আইনজীবী তানজিম পরদিন বগুড়ায় এসএ পরিবহন থেকে নথি তুলে মক্কেলদের ফোন করেন এবং হাইকোর্টের অর্ডারের একটি কপি নিজে সংরক্ষণ করেন। এছাড়াও নিয়ম অনুসারে, হাইকোর্টের আদেশের কপি মক্কেলদেরকে বিচারিক আদালতে দাখিল করতে এবং একটি অনুলিপি থানায় জমা দেওয়ার পরামর্শ দেন।

কিন্তু সেদিন (২৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে তানজিমের মক্কেলরা তাকে ফোন দিয়ে জানান যে, থানার ওসি ফোন করে বলেছেন হাইকোর্টের জামিন আদেশের বিষয়টি ভুয়া। এরপর রাজিব ও তানজিমের মধ্যে কয়েকদফা আলাপ হয়। ওই বেঞ্চের (হাইকোর্টের) ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে দিয়ে ওসিকে ফোন দেওয়া হবে বলে তখন জানান রাজিব। তবে এর কিছুদিন পর থেকে রাজিবের মোবাইল নম্বর বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে সেদিন (২৪ ফেব্রুয়ারি) রাতেই ‘বগুড়ায় জামিন জালিয়াতি, ৩০ জনের জামিন বাতিল এবং তাদেরকে সাত দিনের মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশ’ শিরোনামে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে স্ক্রল প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাত ১০টার সময় রাজিবের ফেসবুক ডিঅ্যাক্টিভেট হয়ে যায়। তবে মেসেঞ্জার ডিঅ্যাক্টিভ না হওয়ায় রাজিবের সঙ্গে তানজিমের কথোপকথনের যাবতীয় আলাপের স্ক্রিনশট থেকে যায়।

পরে ওই মামলার ৩০ জন আসামি অন্য আইনজীবীর মাধ্যমে হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন। আইনজীবী তানজিম তাদেরকে জাল নথি সরবরাহ করেছেন বলেও আদালতকে জানান তারা। এরপর হাইকোর্ট রুল জারি করেন। পাশাপাশি আইনজীবী তানজিম সম্পর্কে জানতে এবং জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত ও এর পেছনে কারা আছেন, তা খুঁজতে একটি কমিটি গঠন করে দেন হাইকোর্ট।

জানা গেছে, তানজিম ও রাজীবকে কয়েকদফা জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। তদন্ত সংস্থা সিআইডিকে রাজিব জানান, ‘আসামিদের জামিন করাতে তিনি মামলার নথিপত্র হাইকোর্টের এক আইনজীবীর সহকারীকে দিয়েছিলেন।’

বাংলা ট্রিবিউনের হাতে আসা বেশকিছু তথ্য অনুসারে, সেগুনবাগিচায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পাশে পাঁচ তলা একটি ভবনে রাজিব ও তার স্ত্রীর ‘নেমপ্লেট’ সংবলিত চেম্বারের খোঁজ পাওয়া যায়। তবে বারবার চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। এমনকি ওই চেম্বারটিও কয়েকদিন ধরে বন্ধ পাওয়া যায়। পুলিশ ও সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে কিছুদিন পর ওই নেমপ্লেট সরিয়ে নেওয়া হয় বলে ধারণা করা হয়। সেগুনবাগিচায় ওই বাড়ির মালিকের কাছে জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, আইনজীবী সামসুদ্দিনের কাছে ভাড়া দিয়েছিলাম। তিনি কাদেরকে সঙ্গে রেখেছেন, সে বিষয়টি আমাদের জানা নেই।’

এদিকে ওই ঘটনায় প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করে রাজধানীর রমনা মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছেন আইনজীবী তানজিম। তানজিমের পরিবারের দাবি, ঢাকায় যাওয়ার পর থেকে গত ৪ মাস ধরে তানজিম বাড়ি ফিরছে না, তার খোঁজ নেই। এমনকি ঈদের সময়ও সে বাড়িতে ফেরেনি।

ঘটনার শুরু থেকেই দায় এড়ানোর চেষ্টা সত্ত্বেও নিজের তৈরি ফাঁদে নিজেই ধরা পড়েছেন রাজিব। ঘটনার সঙ্গে নিজের ‘অজ্ঞতা’ ছিল জানিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক বরাবর একটি চিঠি দেন তিনি। ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন— হাইকোর্টে মামলা পরিচালনা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা না থাকায় অন্য আইনজীবীর সহকারী সোহাগকে দিয়ে মামলাটির জামিন করানো হয় এবং জামিন আদেশের অনুলিপিটি ‘সরল বিশ্বাসে’ আইনজীবী তানজিমের কাছে পাঠান বলেও চিঠিতে স্বীকার করেন তিনি।

আইনজীবী রাজিবের কাছে ভোগান্তির শিকার আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার কাজী মারুফুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। তাই একটি পারিবারিক মামলায় আমার মক্কেলকে রাজিবের কাছে জজ কোর্টে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু জাল আদেশ দিয়ে রাজিব আমার মক্কেলের সঙ্গে প্রতারণা করে এক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পরে অনেক কৌশলে সেই টাকা ফেরত এনেছি।’

ব্যারিস্টার তানজিব উল আলমের চেম্বারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজিব কয়েকদিন ওই চেম্বারে কাজ করলেও শেষ পর্যন্ত কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি ওই চেম্বার ছেড়ে চলে যান।

এদিকে পুরো বিষয়টিকে খতিয়ে দেখতে সিআইডির প্রতি কঠোর নির্দেশনা রয়েছে হাইকোর্টের। ঘটনার তদন্ত করে হাইকোর্টে প্রতিবেদনও দিয়েছে সিআইডি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কোর্টের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সামিরা তারান্নুম মিতি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে মনে হয়েছে, ঘটনাটির সূত্রপাত ঢাকাতেই। ঢাকা থেকেই আইনজীবী রাজিব জাল নথি বানিয়ে বগুড়ায় পাঠিয়েছিলেন। আমরা জানি, আগাম জামিনের শুনানিতে আসামিদের আদালতে হাজির হয়ে জামিন চাইতে হয়। কিন্তু বগুড়ার আইনজীবী তার মক্কেলদের ঢাকাতে না পাঠিয়েই জামিন করাতে চেয়েছিলেন। ফলে কিছুটা দায় তার ওপরও বর্তায়।’

তিনি বলেন, ‘এ মামলায় বুধবার (২৩ জুন) হাইকোর্টে শুনানি চলাকালে রাজিব পক্ষভুক্ত হতে চেয়ে আবেদন করেন। কিন্তু হাইকোর্ট তখনই নির্দেশ দিলে রাজিবকে গ্রেফতার করা হয়। পাশাপাশি এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে আদালত মামলার শুনানির জন্য ১২ জুলাই দিন নির্ধারণ করেছেন।’