সিবিএন ডেস্ক
সহিংসতার শিকার হয়ে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের শেষদিকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেন মোহাম্মদ ইছুপ (৩৫)। টেকনাফ শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি এলাকায় অবিস্থত এ শিবিরে ২১ হাজার মানুষের বসতি। সে সময় পরিবারের চার সদস্য নিয়ে এসেছিলেন ইছুপ; এখন সদস্য সংখ্যা আটজন। এখনও সেই ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন তারা।
উনচিপ্রাং শিবিরে কথা হয় রোহিঙ্গা নেতা ইছুপের সঙ্গে। তিনি বলেন, দাতা সংস্থা থেকে দেওয়া ঘরের ত্রিপল, বাঁশ ও রশি সবই পুরোনো হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানিতে ঘর তলিয়ে যায়। বাতাস হলে উড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। এখানে এসে নিজে চোখে না দেখলে অথবা না থাকলে সংকটের ব্যাপ্তি অনুধাবন করা খুবই কঠিন।
তিনি বলেন, প্রতি বছরে পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে; কিন্তু তত থাকার জায়গা কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের শিক্ষা বিষয়ে চিন্তিত আমরা। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাচ্ছে শিক্ষা ছাড়াই। তাদের ভবিষ্যতে কী হবে?
আগের তুলনায় ক্যাম্পে মারামারি, হানাহানি অনেকটা কমেছে উল্লেখ করে মোহাম্মদ ইছুপ বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া। সম্প্রতি নাফ নদ পাড়ি দিয়ে মিয়ানমার চলে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার প্রাণহানির খবর পেয়েছি। কিন্তু আমরা সেভাবে যেতে চাই না। যেহেতু বাংলাদেশ সরকার আমাদের দায়িত্ব নিয়েছে, তারাই সিদ্ধান্ত নেবে কীভাবে পাঠাবে। বর্তমানে মিয়ানমারে দুটি পক্ষ হয়ে গেছে। একটি পক্ষ রোহিঙ্গাদের মেনে নিতে রাজি। তাই মনে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের সময় এসেছে।’
চার ছেলেমেয়ে নিয়ে মিয়ানমার থেকে আসেন নূর আয়েশা। শিবিরে আরও দুটি মেয়ে জন্ম দেন এই নারী। ত্রাণ সহায়তায় সংসার চললেও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত তিনি।
টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের নূর আয়েশা বলেন, সন্তানদের নিয়ে খুবই হতাশায় থাকি সবসময়। বিশেষ করে কন্যাদের বেশি। ক্যাম্পের প্রতি ঘরে পাঁচ-ছয়জন করে শিশু রয়েছে। তাদের বেড়ে উঠা, ভবিষ্যৎ কী হবে- এই ভাবনায় উদ্বিগ্ন থাকি রাতদিন। এখানে বেড়ে উঠা শিশুরা পাচার হয় অনেক সময়। এ জন্য আরও ভয় লাগে।
তিনি বলেন, ক্যাম্পে বেশিরভাগ কন্যাশিশুরা শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয়। কন্যাশিশুদের এখানে বোঝা মনে করে। মা হিসেবে বিষয়টি মানতে পারি না। তবে উপায়ও থাকে না। কারণ আরও সন্তানদের কথাও ভাবতে হয়।
২০১৭ সালের আগে দুই হাজার পরিবারের সাড়ে ৮ হাজার রোহিঙ্গা নিয়ে গড়ে ওঠে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবির। এখন সেখানে ৩৬ হাজার ঘন মানুষের বসতি। চার বছরে সেখানে মানুষ বেড়েছে সাড়ে চার গুণ।
লেদা ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বলেন, প্রতি বছর মানুষ বাড়ছে। কিন্তু থাকার ঘরের জায়গা তা বাড়ছে না। এটা সত্যিই যে, গত কয়েক বছরে এখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ উন্নতি হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এখন আগের মতো গুম, হত্যা ও অপহরণের মতো ঘটনা ঘটে না। তবে মাঝেমধ্যে মাদক উদ্ধারের মতো ঘটনা ঘটছে। করোনাকাল হওয়ায় বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে এ শিবিরে কোনো আয়োজন করা হয়নি। আমাদের একটি চাওয়া, সেটি হচ্ছে কখন নিজ দেশে ফিরে যাব।’
ইউএনএইচসিআরের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নতুন করে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে বাংলাদেশে ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪৩ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। এর আগে ৩৭ হাজার ২১৬ পরিবারের এক লাখ ৫০ হাজার ৬৯৮ রোহিঙ্গার বসতি ছিল। এখন ৮ লাখ ৮৪ হাজার ৪১ রোহিঙ্গার বসতি। এর মধ্যে শূন্য থেকে ৪ বছরের ৭০ হাজার ৭২৪ জন মেয়েশিশু, ৫ থেকে ১১ বছরের ৬১ হাজার ৮৮৩ জন ছেলেশিশু, ৯৭ হাজার ২৪৪ মেয়ে, ৯২ হাজার ৮২৪ জন ছেলে। এ ছাড়া ১২ থেকে ১৭ বছরের ৫৩ হাজার ৪২ জন মেয়ে এবং ১৮ থেকে ৫৯ বছরের মেয়ের সংখ্যা এক লাখ ৫৯ হাজার ১২৭ জন, ১৭ শতাংশ পুরুষ এক লাখ ৫০ হাজার ২৮৭ জন। ৬০ বছরের বেশি বয়সী নারী ১৭ হাজার ৬৮০ জন, পুরুষ ১৭ হাজার ৬৮০ জন। -সমকাল।