মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির

দুদকের অনুসন্ধান যতই এগিয়ে চলেছে বিস্ময়করভাবে ততই বেরিয়ে আসছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের এনআইডি হাতিয়ে নেয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য। এ এনআইডি নিয়ে অনেকে পেয়ে গেছে পাসপোর্টও। ধরাও পড়েছে বহু। এ জাতীয় এনআইডি হাতিয়ে নেয়ার নেপথ্যে রয়েছে মূলত প্রধান চার চক্র। এরা হচ্ছে ইসির (ইলেকশন কমিশন) বিভিন্ন কার্যালয়, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুর্নীতিবাজ কিছু সদস্য, অসৎ কিছু জনপ্রতিনিধি ও দালাল চক্রের সদস্য।

ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে ৬ মামলায় ৫৫ হাজার ৩১০ রোহিঙ্গা এনআইডি পেয়ে যাওয়ার ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে। মামলা হয়েছে ৬। ইসি, পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৫১ জনের বিরুদ্ধে হয়েছে মামলা। চট্টগ্রামে বর্তমানে এ সংক্রান্তে আরও ১২টি মামলার জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দুদক সদর দফতরের একটি সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট অবৈধ পথে প্রাপ্তি সংক্রান্তে জালিয়াতি এবং এর সঙ্গে জড়িত সরকারী সংস্থাসমূহের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দালালচক্রের অর্জিত সম্পদের অনুসন্ধানও এগিয়ে চলেছে। অভিযুক্ত অনেকের কাছ থেকে সম্পদের বিবরণীর তথ্য চাওয়া হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর দুদক এ সংক্রান্তে ছয় সদস্যের একটি কমিটি করেছে। এ জাতীয় বেশকিছু অনুসন্ধানী রিপোর্ট বর্তমানে সদর দফতরের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ সংক্রান্তে দুদক সদর দফতর একটি কমিটি করে দিয়েছে। কমিটির বর্তমান প্রধান হচ্ছেন সংস্থার চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মাহমুদ হাসান। অপর সদস্যরা হলেন উপপরিচালক মাহবুবুল আলম, সুভাষ চন্দ্র দত্ত, উপসহকারী পরিচালক মোঃ সালাহউদ্দিন, জাফর সাদিক শিবলী ও মোঃ শরীফ উদ্দিন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার অবস্থান রয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ রয়েছে উখিয়া টেকনাফের আশ্রয় শিবিরে। শিবির থেকে বেরিয়ে গেছে লাখো রোহিঙ্গা। এরা ছড়িয়ে রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। দালাল চক্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে সরকারী সংস্থা, জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশে প্রথমে জন্মনিবন্ধন, পরবর্তীতে এনআইডি এবং আরও পরে পাসপোর্ট পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে। এটি একটি বিস্ময়কর ঘটনা। যেখানে সরকার শক্ত হাতে এ অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে সেখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে অনিয়ম দুর্নীতির ঘটনা প্রকারান্তরে বেড়েই চলেছে। সূত্র মতে, এ প্রক্রিয়ায় দুদকের তৎপরতা ও গতি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। অন্যথায় অবৈধ এ প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কক্সবাজার সদরসহ ৮ উপজেলা, চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া, পটিয়া, বাঁশখালী, সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম মহানগরীর ডাবলমুরিং, কোতোয়ালী, চান্দগাঁও। বান্দরবানের সদর, নাইক্ষ্যংছড়ি ও লামা, রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু, খাগড়াছড়ির দুর্গম অঞ্চলের উপজেলাসমূহে উল্লেখযোগ্যহারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা প্রথমে জন্মনিবন্ধন, পরবর্তীতে এনআইডি এবং আরও পরে পাসপোর্ট পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে। চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলে ডবলমুরিং এলাকায় সবচেয়ে বেশি অবৈধ এ কার্যক্রম রয়েছে। ইসির চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সদর দফতরও এ এলাকায় অবস্থিত।

সূত্র জানায়, পাসপোর্ট অফিস সাধারণত এনআইডির সত্যতা যাচাই এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের রিপোর্ট নিয়ে পাসপোর্ট প্রদান করে থাকে। আবেদনকারী সঠিক কিনা তা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চই রিপোর্ট দেয়। কিন্তু জন্মনিবন্ধন সনদ এবং এনআইডি কিভাবে রোহিঙ্গারা হাতিয়ে নিচ্ছে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে ৯৮ হাজার রোহিঙ্গা এনআইডি হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এরপর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের যে ঢল নামে তাদের প্রথম আশ্রয় হয় উখিয়া টেকনাফে। সেখান থেকে দালাল চক্রের মাধ্যমে এরা দেশের অসংখ্য জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। তন্মধ্যে চট্টগ্রাম জেলা, পার্বত্য বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি জেলায় সবচেয়ে বেশি। দালাল চক্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা বাংলাদেশী নাগরিকদের নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে প্রথমে উপজেলা চেয়ারম্যান, মেট্রো অঞ্চলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসসমূহ থেকে জন্মনিবন্ধন কার্ড হাতিয়ে নেয়ার পর ইসি থেকে পেয়ে যাচ্ছে এনআইডি। এরপরে যার যার প্রয়োজনে নিচ্ছে পাসপোর্ট। চলে যাচ্ছে বিদেশে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে। এ জাতীয় রোহিঙ্গা বাংলাদেশী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের মধ্যে সৌদি আরবেই বেশি।

পুরস্কারের বদলে বদলি কেন? দুদকের চট্টগ্রাম মেট্রো-২ অঞ্চলের উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনের অনুসন্ধানে ইতোপূর্বে বেরিয়ে এসেছে কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণের সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা প্রদানের ঘটনায় ব্যাপকহারে আত্মসাত। এরপরে রয়েছে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিপুল অঙ্কের দুর্নীতির ঘটনা এবং সর্বশেষ ৫৫ হাজার ৩১০ রোহিঙ্গাকে এনআইডি প্রদানের জালিয়াতির তথ্য অনুসন্ধানে উদঘাটিত হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে তার অনুসন্ধানে রয়েছে ইউরোপীয়ান কিছু এনজিও কিভাবে রোহিঙ্গাদের অপকর্মে অর্থায়ন করছে। এমনকি আইএসএর সঙ্গে যুক্ত হতে প্রলুব্ধ করছে-তার অনুসন্ধানও এই কর্মকর্তার হাতে।

গত ১৪-১৭ জুন পর্যন্ত ৬টি মামলায় ৫৫ হাজার ৩১০ রোহিঙ্গা যে এনআইডি পেয়েছে এর নেপথ্যের ঘটনা নিয়ে শরীফ উদ্দিনই বাদী হয়ে মামলা করেছেন। এর পরদিনই তার ভাগ্যে জুটেছে বদলির আদেশ। তাও আবার পটুয়াখালীতে। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে, এটা তার চ্যালেঞ্জিং কাজের সুফলতার পুরস্কার, নাকি দুষ্টচক্রের সিন্ডিকেট সদস্যদের কলকাঠি নাড়ার ফলশ্রুতিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। আগামী ১ জুলাই তাকে পটুয়াখালীতে যোগ দিতে বলা হয়েছে। অথচ চট্টগ্রাম অঞ্চলে তার হাতে দুর্নীতির অসংখ্য অনুসন্ধান কাজ রয়েছে। যার মধ্যে চারটি স্টিলমিলের দুর্নীতি, রোহিঙ্গাদের অবৈধ পথে অর্থায়নের ঘটনা, কাল টাকার মাধ্যমে বিত্তশালী হয়ে যাওয়া কয়েকজনের সম্পদের অনুসন্ধান রিপোর্ট দুদকের সদর দফতরে জমা রয়েছে। কিন্তু অনুমোদন প্রক্রিয়াটি ঝুলিয়ে রখা হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, এসব ঘটনা দুদকের চেয়ারম্যান এবং অপর দুই সদস্য জ্ঞাত নহেন। এমনকি শরীফ উদ্দিনের বদলির ঘটনাটিও দুদক চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনারের জ্ঞাতসারে হয়নি। এসব বিষয় নিয়ে দুদকের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। যে কর্মকর্তা এসব ঘটনা উদঘাটন করেছেন এমনকি বাংলাদেশের জন্য বর্তমানে বোঝা হয়ে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা ব্যাপকহারে যে জন্মসনদ ও এনআইডি পেয়েছে এমনকি অনেকে পাসপোর্টও হাতিয়ে নিয়েছে সে রহস্যের উদঘাটনকারী দুদক কর্মকর্তাকে যেখানে পুরস্কৃত করার কথা, সেস্থলে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, জালিয়াত চক্রের সঙ্গে জড়িত ইসির উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে এ কর্মকর্তাকে বদলি করে দেয়ার ঘটনা নিহিত রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, রুটিনমাফিক বদলি যে কোন সংস্থার এখতিয়ারভুক্ত। কিন্তু যেখানে চাঞ্চল্যকর অবৈধ কার্যক্রমের ঘটনা বেরিয়ে আসছে, সেখানে তা উদঘাটন প্রক্রিয়ায় যারা জড়িত তাদের কার্যক্রমে আরও গতিশীলতা সৃষ্টির বিপরীতে বদলির বিষয়টি প্রকারান্তরে দুর্নীতির চালচিত্র উদঘাটন থমকে দেয়ার প্রয়াস কিনা তা নিয়েও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

– জনক্ন্ঠ