রহিম আব্দুর রহিম :

গত ১৫ জুন জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি শিরোনাম ছিল, “শ্রেণিকক্ষে ফেরা অনিশ্চয়তা”। শিরোনামের ফিডার লাইন ছিল, ‘মানসিক চাপে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা, মাদকে আসক্তি, অনলাইন ক্লাসে আগ্রহ কম, চিন্তিত অভিভাবক, অনেক শিশুকে স্কুলে ভর্তি করা হয় নি।’ রিপোর্টটির বডির সারাংশ, ‘একজন শিশু নতুন স্কুলে যেতে চায়, তার বন্ধু পেতে চায়, ল্যাপটপে ক্লাস ভাল লাগে না। দীর্ঘ সময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় হতাশা, অস্থিরতায় গত ১৫ মাসের ব্যবধানে ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। যার মধ্যে স্কুল শিক্ষার্থী ৭৩ জন, কলেজ পড়–য়া ২৭ জন, মাদ্রাসা পড়–য়া ২৯ জন এবং বিশ^বিদ্যালয় ও মেডিক্যাল অধ্যায়নরত ৪২ জন।’ এই প্রতিবেদক প্রতিবেদন তৈয়ারকালে বিশ^বিদ্যালয় পড়–য়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাছিমা আক্তারের সাথে কথা বলেন। ওই অভিভাবক বলেন, ‘দেড় বছর ধরে ছেলে ক্লাসে যায় না। সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ায় আড্ডা দেয়, রাত করে বাসায় ফিরে। সারারাত ফেসবুক আর ভিডিওগেম খেলে ভোরে ঘুমায়। দুপুরে ঘুম থেকে ওঠে। লেখাপড়ার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।’ প্রতিবেদক এ ব্যাপারে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন পোদ্দারের মতামতও গ্রহণ করেছেন। ওই ডাক্তার বলেছেন, ‘অনলাইন ক্লাস এবং বিনোদন সবই ইন্টারনেট ভিত্তিক হয়ে পড়ায় শিশুর জন্য নেতিবাচক।’ প্রকাশিত রিপোর্টটি গবেষণাধর্মী এবং দেশ ও জাতির সার্বিক চিত্রের মোটামুটি প্রতিচ্ছবি। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে অনলাইন ইন্টারনেটে দীর্ঘ সময় থাকলে মানুষের গুণাবলি যথেষ্ট লোপ পায় এবং ওই ব্যক্তি মানসিক এবং আচরণগতভাবে কিছুটা যান্ত্রিক হয়েও পড়ে।

পত্রিকায় যা প্রকাশ হয়েছে, বাস্তবতা তার চেয়েও ভয়াবহ। উন্নয়নশীল বাংলাদেশে ৩ শ্রেণির জনমানুষ শিক্ষার মত মৌলিক অধিকার ভোগ করে থাকেন। এর একটি উচ্চবিত্ত, যারা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান বা বিদেশে শিক্ষা গ্রহণ করেন। দ্বিতীয়ত, মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা নিজ ঘরে বা প্রাইভেট ক্লাসে পড়াশোনা করার সুযোগ পায়। তৃতীয়ত, নি¤œমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা জীবন যুদ্ধের পাশাপাশি সময় সুযোগে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। দীর্ঘ সময় সাংবিধানিক অধিকার ‘শিক্ষা’ অর্জনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নি¤œমধ্যবিত্তের ঘরের ৭০% শিক্ষার্থী লেখাপড়ার ইতি টেনেছে। ৩০% শিক্ষার্থীরা বাল্যবিবাহের মত ঝুঁকিপূর্ণ জীবনসম্পৃক্ত কাজে আবদ্ধ হয়েছে। মধ্যবিত্ত ঘরের প্রায় ৮০% শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের জন্য এনড্রয়েড মোবাইল পেয়ে তারা প্রযুক্তিগত জীবনবিধ্বংসী গেম বা নীল জগতে সময় পার করছে। প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবন অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

ইউনিসেফের দেওয়া এক তথ্যে জানা যায়, করোনা ইস্যুতে পৃথিবীর ৩ টি দেশ সবচেয়ে বেশি দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে। এর মধ্যে প্রথম পানামা, দ্বিতীয় এলসাল্ভেদর এবং তৃতীয় স্থানে বাংলাদেশ। কাল এবং যুগের ব্যবধানে পৃথিবীর সকল মহামারী সামাল দিতে আক্রান্ত প্রতিটি রাষ্ট্রই চলাফেরা নিয়ন্ত্রনে স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার বন্ধ রেখেছে। তবে তা দীর্ঘ সময়ব্যাপী নয়। যা বাংলাদেশে হচ্ছে তা সত্যিকার অর্থেই দুঃখজনক এবং সংবিধান পরিপন্থী। ‘সংবিধান’ যেমন একটি রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করে তেমনি সাংবিধানিক অধিকার কোনভাবেই যাতে খর্ব না হয়, তা নিশ্চিত করে। ‘সংবিধান একটি রাষ্ট্র ও জাতির রক্ষাকবচ। আর শিক্ষা একটি জাতির মেরুদন্ড। করোনাকালে দেশের সব অঙ্গন সচল থাকলেও মেরুদন্ড স্তব্ধ রাখা, কোনক্রমেই যুক্তিসঙ্গত নয়। তবে কোন রাষ্ট্রের নাগরিক যখন জীবন বিধ্বংসী পরিস্থিতির শিকার হয়, ওই সময় রাষ্ট্র পরিচালকরা সংবিধান বাইপাস করে প্রজ্ঞাপন জারি করতেই পারেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিচালনার সকল যন্ত্র এবং রাষ্ট্রের বৈধ রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনগুলো দেশ ও জাতির স্বার্থে যার যার অবস্থান থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলার করবে এবং তা উত্তরণের উপায় অন্বেষণ করবে।

দীর্ঘ প্রায় ১৬ মাসের ব্যবধানে অদৃশ্য মহামারী করোনার ইস্যুতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বার বার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়াচ্ছে। যা কোনক্রমেই ইতিবাচক নয়। অথচ আজ পর্যন্ত দেশের কোন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা প্রতিষ্ঠান চালু করার উপায় নির্নয় করার জন্য সরকারকে চাপে রাখে নি বা উপায় নির্নয় করে তা ফলো করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেয় নি। একটি মহল মনে করছে, দেশের সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সম্ভবত মনে মনে খুবই খুশি এই বলে যে, করোনা ইস্যুতে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখায় সরকারের ভাবমূর্তি তলানিতে ঠেকেছে। জাতি ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে। এই মহলটি এটাও মনে করে যে, সরকার বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো এই ইস্যুটি কাজে লাগাতে পারছে না বলে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি তাদের চরম ক্ষোভ রয়েছে। রাজনৈতিক সচেতনরা বলছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ছাড়া এদেশে কোন ব্যক্তিই জনমানুষের জন্য রাজনীতি করে নি, করছে না। দেশে রাজনীতির নামে যা হচ্ছে তা ঘোড়ার ডিম।’ তবে সম্প্রতি বিএনপি আমলের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এহসানুল হক মিলনের একটি প্রতিক্রিয়াকে জাতি সাদরে গ্রহণ করেছে। গত ১৪ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, ‘১ বছর পরীক্ষা না দিলে বিরাট ক্ষতি হবে না।’ এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সাবেক এই শিক্ষামন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে শিক্ষামন্ত্রীও এক বছর ছুটিতে গেলে দেশের কি ক্ষতি হবে?’ তিনি রেডিও তেহরান কে বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, করোনার চেয়ে নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে জাতির জন্য শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কেন নয়? আসলে ক্ষমতাসীনরা চাচ্ছে, জাতিকে অশিক্ষিত রাখতে।’ সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া সমর্থনযোগ্য তবে বিতর্ক রয়েছে তাঁর প্রতিক্রিয়ার একাংশে, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘আসলে ক্ষমতাসীনরা চাচ্ছে জাতিকে অশিক্ষিত রাখতে।’ এই বাক্যটির প্রচন্ড বিরোধিতা করছি এই কারনে যে, গত ২০২০ সালের মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে দেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিক বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘করোনা মহামারী ছড়িয়ে যাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে বন্ধ করবেন?’ সাংবাদিকের এই প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এখনও সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় নি।’ এরপর মিডিয়াতে যা হবার তাই হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে সরকার বাধ্য হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ওই মিডিয়া দীর্ঘ ১৬ মাসের ব্যবধানে আজ পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন নি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কবে সশরীরে পাঠদান শুরু করবেন, বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা যুক্তিসংগত কি না? এখন বলুন, জাতিকে অশিক্ষিত করার পেছনে কলকাঠি কাদের হাতে?

ধরে নিলাম, রাজনৈতিক দলগুলো জনমানুষের জন্য রাজপথে কিছুই করছে না, করতে পারছে না। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এবং শেখ হাসিনার অনুসারী ছাত্রসংগঠন, জাতির মেরুদন্ড শিক্ষাঙ্গন চালু রাখতে কেনো রাজপথে আন্দোলনে আসছে না? এরা কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদে দেওয়া অনুপ্রেরণা ও অগ্নিসম সাহসী বাক্যমালা শোনেনি? তিনি সংসদে দেওয়া ভাষণের এক পর্যায়ে বলেছেন, ‘আমি সংসদে আসবো। কিন্তু অনেক জায়গা থেকে আমাকে সংসদে আসতে নিষেধ করা হয়েছিল। ভীষণভাবে বাঁধা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, না আপনি যাবেন না। নেত্রী যাবেন না। তা আমি বললাম, হুমকি, বোমা, গ্রেনেড কতকিছুই তো মোকাবেলা করে করে এ পর্যন্ত এসেছি, এখন কী একটি অদৃশ্য শক্তির ভয়ে ভীত হয়ে থাকবো?’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে এ ধরনের বক্তব্য রেখে মহামারী কালে সাহসের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, সেখানে ছাত্রসমাজ তাদের অধিকার আদায়ে নীরবতা কি প্রমাণ করে না? আমরা যারা বিবেক নির্দেশক, তাঁরা কি শিক্ষার্থীদের মনে আগুন জ¦ালাতে পেরেছি!

দুঃখজনক হলেও সত্য, যে দেশের রাজনীতির বাক্সে ‘ঘোড়ার ডিম’, ‘বিবেকের পাল্স’ নড়েবড়ে, সেই দেশে ‘নন্দনাল’দের জন্ম নিশ্চিত।

রহিম আব্দুর রহিম- শিক্ষক, লেখক, গবেষক ও নাট্যকার।