আহমদ গিয়াসঃ
বঙ্গোপসাগরের একমাত্র লিভিং ফসিল বা ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’ নামে পরিচিত নীল রক্তের সামুদ্রিক প্রাণি ‘রাজ কাঁকড়া’ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে দেশের সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছেন বিজ্ঞানীরা। রক্তের ওষুধী গুণের কারণে বিশ্ববিখ্যাত এই প্রাণিটি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বে আরো ছয়-সাত দশক আগে গবেষণা শুরু হলেও বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো ব্যাপকভিত্তিক গবেষণার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একটি রাজকাঁকড়ার রক্তের দাম বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে অন্তত ১৫ লাখ টাকা। এবিষয়ে ২০১৯ সালের নভেম্বরে দৈনিক আজাদীতে একটি লিড নিউজ প্রকাশিত হয়।
রাজকাঁকড়া বঙ্গোপসাগরের একমাত্র ‘লিভিং ফসিল’, যেটি ডাইনোসর যুগেরও আগের বা ৪৫ কোটি বছর পুরনো আদি প্রাণি বলে ধারণা করা হয়। অলৌকিক ওষুধী গুণের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে রাজ কাঁকড়ার এক গ্যালন রক্তের দাম ৬০ হাজার মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশী মূদ্রায় প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা। চিকিৎসা শাস্ত্রে রাজ কাঁকড়ার নীল রক্ত এক যাদুকরী বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। মানুষের শরীরের দ্রæত রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে এবং মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করতে কাঁকড়ার নীল রক্ত অতুলনীয়। এছাড়া এর শরীরের পেছনে থাকা ছোট্ট লেজটি দিয়ে তৈরি করা হয় ক্যান্সারের মহা ওষুধ। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে একেকটি রাজ কাঁকড়ার দাম অন্তত পনের লক্ষ টাকা বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই প্রাণিটি ‘দিয় কিঁয়ারা’ বা দৈত্য কাঁকড়া নামেই সমধিক পরিচিত। একটি নারী রাজ কাঁকড়া বছরে ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার পর্যন্ত ডিম দেয়। এরমধ্যে কয়েক হাজার বেঁচে থাকে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।
মাত্র ২ যুগ আগেও কক্সবাজার শহরসহ দেশের বিভিন্ন সমুদ্র উপক‚লের জোয়ারভাটা অঞ্চলে ঝাঁকে ঝাঁকে রাজ কাঁকড়া দেখা যেত। কিন্তু বিস্তীর্ণ উপক‚ল থেকেই এ প্রাণিটি একেবারেই হারিয়ে গেছে। তবে বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে প্রাণিটি হারিয়ে গেলেও এখনও জেলার বিভিন্ন দ্বীপ ও ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদঘেরা কাদা-বালুকাময় অঞ্চলে টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন এর পর্যবেক্ষণেও বাংলাদেশে প্রাণিটির অবস্থান লাল তালিকায়।
‘জীবন্ত জীবাশ্ম’ নামে পরিচিত বঙ্গোপসাগরের এই আদি প্রাণিটি পৃথিবীর একটি অত্যন্ত প্রাচীন দল। তাদের জীবাশ্মের আত্মীয়রা অর্ডোভিশিয়ান পিরিয়ড (৪৮৫.৪ মিলিয়ন থেকে ৪৪৩.৮ মিলিয়ন বছর পূর্বে) হিসাবে স্বীকৃত। অর্থাৎ জুরাসিক পিরিয়ডের (২০১.৩ মিলিয়ন থেকে ১৪৫ মিলিয়ন বছর আগের) পূর্ববর্তী যুগের এই প্রাণিটি প্রকৃতির চরমতম প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকা একটি আদি প্রাণি।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) এর সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র কক্সবাজার কর্তৃক আয়োজিত ‘বার্ষিক গবেষণা অগ্রগতি (২০২০-২১) পর্যালোচনা ও গবেষণা প্রস্তাবনা (২০২১-২২) প্রণয়ন” শীর্ষক এক আঞ্চলিক কর্মশালায় মৎস্য বিজ্ঞানীরা দেশের ব্লো-ইকনোমি বা সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নে রাজকাঁকড়া নিয়ে গবেষণাসহ নতুন চারটি গবেষণা প্রকল্প প্রস্তাব করেন। পাশাপাশি কর্মশালায় চলমান ২১টি গবেষণা প্রকল্পের অগ্রগতিও তুলে ধরা হয়।
মঙ্গলবার (১৫ জুন) কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সম্মেলন কক্ষে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত উক্ত কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএফআরআই’র মহাপরিচালক ড. মো: ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকি পরিকল্পনা, সুনীল অর্থনীতি এবং এসডিজি লক্ষ্য পূরণের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং মাঠ পর্যায়ে সফলতা বৃদ্ধির জন্য বেশি পরিমাণে প্রকল্প গ্রহণের চেয়ে গবেষণার গুনগত মানের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বিএফআরআই। দেশীয় ও আন্তজার্তিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন পণ্য ও তাদের বাই প্রোডাক্ট বা উপজাত নিয়েও আমাদের গবেষণা করতে হবে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে কোরাল মাছের কেজ কালচারসহ সমন্বিত মেরিকালচার প্রযুক্তির উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এছাড়া
লাইভ ফিড গবেষণা প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন ধরনের ফাইটোপ্লাংকটন ও জ্যুওপ্লাাংকটন আইসোলেশন ও চাষ করা হচ্ছে। সমুদ্র থেকে এগুলো পৃথকীকরন করে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে, যা পরবর্তীতে কক্সবাজারস্থ বিভিন্ন কাঁকড়া ও চিংড়ি হ্যাচারী গুলো প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ করা হবে।
কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র প্রধান ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত কর্মশালায় বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রামস্থ মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো: শাহজাদা খসরু ও কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম খালেকুজ্জামান বিপ্লব। কর্মশালায় বিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, জেলা- উপজেলা পর্যায়ের মৎস্য কর্মকর্তা, উদ্যোক্তা, চাষী, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।