জসিম মাহমুদ, টেকনাফ:
বেলা একটা। শাহপরীর দ্বীপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জড়ো হতে থাকেন অসহায় নারী-পুরুষরা। এসব নারী-পুরুষেরা হলেন টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের নাফনদীর তীর ঘেঁষা শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়া। এটি একটি জেলেপল্লী। এখানে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষের বসবাস। এরমধ্যে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ নাফনদীর বেড়িবাঁধের বাহিরে বসবাস করে আসছিল। এলাকার অধিকাংশ মানুষের প্রধান পেশা মাছ ধরা। তবে সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে তাণ্ডবে এ জেলেপল্লীর মানুষগুলোর বসতবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি মেনে মুখে মাস্ক পরে জড়ো হওয়া মানুষগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে চাল, আলু, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল ও মাস্কসহ জনপ্রতি একটি করে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে খাদ্য সামগ্রীর প্যাকেট।
গতকাল শনিবার দুপুরে শাহপরীর দ্বীপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ক্ষতিগ্রস্ত জালিয়াপাড়ার (জেলেপল্লীর) ১০০পরিবারে ১০ কেজি ওজনের ওই বস্তার ভিতর ছিল চাল, আলু, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল ও মাস্ক।
স্বামী পঙ্গু মোহাম্মদ তৈয়ুব। চার বছর আগেও ছিলেন একজন জেলে। নাফ নদীতে ছোট্ট নৌকায় বড়শিতে মাছ শিকার করে সংসারের খরচ জোগান দিতেন। ওই সময় পরিবারে অভাব-অনটন ছিল না। হঠাৎ করে ডান পায়ে একটি ফুড়া তার জীবন পঙ্গু করে দিয়েছে। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বর্তমানের পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই বরশি নৌকাটি অন্য জেলেদের দিয়ে বগায় কিছু খাবারের মাছ পেলেও চার বছর ধরে সেটিও আর এখন পাচ্ছি না’। নষ্ট হতে চলছে একমাত্র সম্বলটি। দীর্ঘ চারটি বছর ধরে পঙ্গুত্ব জীবনযাপন নিয়ে পড়ে থাকলেও এলাকার জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধরনা দিলেও এ পর্যন্ত পঙ্গু ভাতার তালিকায় নাম উঠেনি। শুধু স্বামী তৈয়ুব নয়। আমার সংসারে স্বামীর বড় বোন (ননাস) খতিজা বেগম দুই পা জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী হলেও সেও কোনো ধরনের তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। পঙ্গুত্ব জীবনের কারনে কেহ তার সঙ্গে বিবাহ করতে রাজি হয়নি। বৃদ্ধা শশুর, ননাস, তিন ছেলে-মেয়েসহ ৭জনের সংসার। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামতের কোনো সামর্থ্য নেই, নেই কোনো জমিও। পাউবোর সরকারি খাস জমিতে নাফনদীর তীরে কোনোভাবেই জীবন-যাপন করেছিল। সংসারে খাবারের খুবই সংকট চলছিল। কেউ তো আমাদের খবর নিল না। ঠিক তখনই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আমিসহ জেলে পরিবারগুলোর জন্য খাবার দিয়েছে। অন্তত কয়েকদিন ভালোভাবে দুই বেলা ভাত খেতে পারবে পরিবার-পরিজন। এসব কথা জানালেন জেলেপল্লীর পঙ্গু স্বামী ও জেলে মোহাম্মদ তৈয়ুবের স্ত্রী দিল কায়েস (৩৫)।
একই এলাকার গৃহবধূ জুলেখা বেগম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি সবকিছু ভেঙে গেছে। জোয়ারে ঢেউ এখন ঘরের কাছাকাছি চলে এসেছে। বর্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছি। এরমধ্যে প্রথম আলো খাদ্য সামগ্রী দেওয়াই জেলে পল্লীর মানুষের মুখে হাসি দেখা যাচ্ছে।
জেলে আব্দুল গফুর বলেন, জেলেপল্লীর খবর কেউ না রাখলেও প্রথম আলো রেখেছে। এতোদিনেও আমরা কোনো সরকারি সাহায্য সহযোগিতা পায়নি। কিন্তু আজ প্রথম আলো আমাদের কাছে খাদ্য সামগ্রীর পাঠিয়েছে। এজন্য প্রথম আলোকে ধন্যবাদ।
শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়া ক্ষুদ্র মৎস্যজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নূরু বলেন, নাফনদীর তীরে এই জেলেপল্লীর জন্য প্রথম আলো এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। জেলেরা এটি সারাজীবন মনে রাখবে। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জেলেরা কোনো ত্রাণ সহযোগিতা কিছুই পাইনি। এরমধ্যে ২০ মে থেকে সাগরে এখন মাছ ধরার উপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সরকারি তালিকাভুক্ত এ জেলে পল্লীতে কোনো ধরনের খাদ্য সহায়তা পায়নি।
খাদ্য সহায়তা বিতরণকালে উপস্থিত টেকনাফ উপজেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও শাহপরীর দ্বীপের প্রবীণ শিক্ষক মাস্টার জাহিদ হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত শাহপরীরদ্বীপের এই জেলেপল্লীতে প্রথম আলো ট্রাস্টের পক্ষ থেকে ১০০ পরিবারকে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। আসলেই প্রথম আলো বদলে দেওয়ার অগ্রদূত। তাদের অনুসরণ করা খুবই প্রয়োজন। সমাজের প্রতিটি বিত্তশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এভাবে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
খাদ্য সামগ্রী বিতরণকালে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন – প্রথম আলোর টেকনাফ প্রতিনিধি গিয়াস উদ্দিন, কালের কণ্ঠের টেকনাফ প্রতিনিধি জাকারিয়া আলফাজ, দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার টেকনাফ প্রতিনিধি জসিম মাহমুদ ও আব্দুল গফুর প্রমুখ।