বলরাম দাশ অনুপম :
প্রতিবছর বর্ষা এলেই পাহাড়ে বাস করা পরিবারগুলোকে সরিয়ে নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করে কক্সবাজার প্রশাসন। কিন্তু এরপর ‘হুঁশ’ থাকে না কারোই।
প্রতিবছর বর্ষায় কক্সবাজার শহরের বৈদ্যঘোনা, পাহাড়তলী, সার্কিট হাউস, টেকনাইফ্যা পাহাড়, হিমছড়ি, মহেশখালী উপজেলাসহ সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ ও উখিয়ায় পাহাড়ধসে মৃত্যু নিয়মিত ঘটনা। এরপরও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে বাস করছে প্রায় ৩ লাখ মানুষ। এক যুগে দেড়শ’র বেশি মানুষ পাহাড়ধসে প্রাণ হারালেও হুশ ফিরছে না পাহাড়ে থাকাদের।
জেলায় মোট বনভূমির ৭৩ হাজার ৩৫৮ হেক্টরের মধ্যে অবৈধ দখলে আছে ৯ হাজার ৬৫৭ হেক্টর। এর মধ্যে পাহাড়ি জমিতেই প্রায় ১৩ হাজার ৮২৬টি পরিবারের তিন লাখ মানুষ বসবাস করছে বলে জানিয়েছে কক্সবাজার বনবিভাগ সূত্র।
জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় রয়েছে ৬২টি। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম কিংবা বছরের অন্য সময় ভারী বর্ষণ হলেই কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করা লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। মাইকিং করে সতর্কমূলক প্রচারণা চালান। কিন্তু পরে আবারো সেই পাহাড়েই ঠাঁই নেয় পরিবারগুলো।
আর এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে পাহাড়খেকোরা। নিম্নআয়ের মানুষদের টার্গেট করে টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে পাহাড়ের জমি বিক্রি করছে তারা। বিভিন্ন মামলা-অভিযানের পরও থামানো যাচ্ছে ভূমিদস্যু চক্রটিকে।
ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ে থাকার বিষয়ে পাহাড়তলী হেলালী ঘোনার বাসিন্দা আব্দুল বলেন, আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। দিনমজুরি করে ৭ সদস্যের পরিবার নিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকতে পারি না। পাঁচ বছর আগে এনজিও থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। সেই টাকায় দুই শতক পাহাড়ি জমি কিনে টিন দিয়ে ঘর তৈরি করে বসবাস করছি।
অনেকেই পাহাড়ি জমি কিনে গড়ে তুলছেন বসতি। বাড়ি নয়, যেন টাকা দিয়ে তারা কিনছেন মৃত্যু।
বাদশাঘোনা এলাকার মৌলভী হাফেজ আলম, পাহাড়তলী ইসলামপুরের মো. আমিন, বৈদ্যঘোনার ইলেকট্রিক মিস্ত্রি মো. হোসেন, কলাতলী চন্দ্রিমার ঘোনার খায়রুন্নাহার ও বাদশার ঘোনার হোসনে আরা বেগমরাও আব্দুলের মতো একই পথের পথিক। তবে সরকার মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চিত করলে পাহাড় ছেড়ে দিতে প্রস্তুত বলে জানান তারা।
কক্সবাজারের পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, যারা পাহাড় কাটছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যন্ত ১৪৫টিরও বেশি মামলা হয়েছে। তবে পাহাড়খেকোরা বরাবরই সক্রিয় রয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজার জেলার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, কক্সবাজার শহরের আদর্শগ্রাম, কলাতলী, সিটি কলেজ এলাকা, পাহাড়তলী, ঘোনারপাড়া, খাজা মঞ্জিল, বৈদ্যঘোনাসহ বিভিন্ন এলাকার লক্ষাধিক মানুষ ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ে বসবাস করছে। বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে এসব এলাকায়।
কক্সবাজার পৌরসভার প্যানেল মেয়র কাউন্সিলর হেলাল উদ্দিন কবির বলেন, রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি তৈরির জন্য প্রতিদিন পাহাড় কাটছে। বৃষ্টির পানির সঙ্গে পাহাড় কাটার মাটি নেমে এসে শহরের নালা-নর্দমা ভরাট হয়ে যায়। ফলে পুরো শহরে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। পাহাড়কাটা রোধে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশগুপ্তা বলেন, পাহাড়কাটা বন্ধ ও বসতি উচ্ছেদের জন্য গত জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত অন্তত ২০টি স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। এ সময় নতুন করে তৈরি শতাধিক ঘরবাড়ি উচ্ছেদ এবং পাহাড় কাটার দায়ে মামলা ও জরিমানা করা হয়েছে। তবে এখনো বহু অবৈধ স্থাপনা রয়ে গেছে। এসব স্থাপনা উচ্ছেদে যৌথ অভিযান দরকার। কিন্তু আমাদের লোকবল সংকটের কারণে একসঙ্গে এত অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।